ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে আবর্তন সৃষ্টি হয় তা কেবল ব্যক্তিকে উপকৃত করে না, সমাজের সাধারণ মানুষের বহুবিধ কল্যাণ তা দ্বারা সূচিত হয়। পণ্যদ্রব্যের গতিশীলতা ও স্থানান্তর নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য তা সকলের কাছে সহজলভ্য করে। কর্মসংস্থান বহুবিধ সুযোগ অবারিত করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করে। এসব কারণে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে তাতে নিয়োজিত হতে ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছে।
কোরআনে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে হালাল এবং হারাম হিসেবে পার্থক্য করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, 'হে ইমানদার! তোমরা একে অপরের সম্পদ বাতিল পন্থায় গ্রাস করো না। তবে তা ব্যবসায়ের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্মতিতে হলে বৈধ।' (সুরা নিসা: ২৯)। এখানে বাতিল পন্থা বলতে ইসলামি শরীয়তের বিধি-বিধান পরিপন্থী ব্যবসাকে বুঝায়। অবৈধ ব্যবসাকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে এবং প্রতিহত করতে বিধিবদ্ধ আইন তৈরি করেছে। অন্যদিকে বৈধ ব্যবসাকে ইসলাম অনুমোদন দিয়েছে এবং জীবিকা অর্জনের সর্বোত্তম উপায় হিসেবে তাতে নিয়োজিত হতে ব্যক্তিকে উৎসাহিত করেছে। নিম্নবর্ণিত নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসা-বাণিজ্য ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ ও সুষ্ঠু হিসেবে বিবেচিত হবে।
১. পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে লেনদেন
ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। লেনদেন উভয় পক্ষ যদি লাভবান বা উপকৃত হয় তাহলেই কেবল পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে ওঠবে এবং বৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যথায় তা হবে না। বিক্রেতা যদি অযৌক্তিক অতিরিক্ত মূল্য থেকে অত্যধিক লাভকরতে চায় এবং ক্রেতা বাধ্য হয় সে মূল্যে ক্রয় করতে, তাহলে এক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে লেনদেন হবে না। ইসলাম এ ধরনের লেনদেন অনুমোদন করে না। লাভ একটু কম হলেও ক্রেতার সন্তোষ অনুসারে মূল্য নির্ধারিত হলে পারস্পরিক সহযোগিতা সৃষ্টি হবে।
২. লেনদেনে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি
ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে লেনদেনের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি থাকতে হবে। বিক্রেতা দ্রব্যের যে মূল্য নির্ধারণ করে তা যদি ক্রেতা কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত না হয়, বরং ঐ মূল্যে ক্রেতা ক্রয় করতে বাধ্য হয়, তবে তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি বলা যাবে না। একইভাবে শ্রমিক অভাব-অনটনের কারণে বা অত্যাচারের ভয়ে কম মজুরীতে কাজ করতে বাধ্য হয়, তাহলে তা স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি হবে না। এখানে এক পক্ষের সম্মতি পাওয়া যায়নি। বিপাকে পড়ে জবরদস্তি সম্মতিকেই স্বতঃস্ফূর্ত বলে ধরে নেয়া হয়েছে। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাসূল (সা.) 'বিপাকে পড়ে বাধ্য হয়ে লেনদেন' করতে নিষেধ করেছেন।
৩. প্রতারণামূলক লেনদেন অবৈধ
লেনদেনে ধোঁকা বা প্রতারণার আশ্রয় নেয়া যাবে না। কেননা এর ফলে বিক্রেতা লাভবান হলেও ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নকল দ্রব্য অথবা ভেজাল মিশিয়ে পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করা, নিকৃষ্ট বস্তুতে উৎকৃষ্ট বলে চালিয়ে দেয়া, মাপ বা ওজনে কম দেয়া এসবই প্রতারণার শামিল। এ ধরণের লেনদেন ইসলামে হারাম। জুয়া বা লটারির মাধ্যমে বিক্রয় প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। কেননা তাতে এক পক্ষের নিশ্চিত লাভ এবং অন্য পক্ষের নিশ্চিত ক্ষতি নিহিত রয়েছে। উপরন্ত জুয়া বিনা পরিশ্রমের ফসল। পূর্ণ বিনিময় প্রদান না করে অথবা স্বল্প বিনিময়ের পরিবর্তে অধিক অর্জন। কাজেই তা এক ধরনের আত্মসাৎ, জুলুম ও মারাত্মক প্রতারণা। এ জন্যই জুয়া এবং লটারির মত সকল প্রকার লেনদেন ইসলাম হারাম করেছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একদিন রাসুল (সা.) বাজারে এক স্তুপ খাদ্যশস্যের ভেতর স্বীয় হাত মুবারক ঢুকিয়ে দিলেন। এতে তার আঙ্গুল ভিজে গেলো। তিনি বললেন, 'হে শস্যের মালিক। এটা কি?' সে বললো, 'এগুলো তো বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে।' রাসুল (সা.) বললেন, 'তুমি স্বপের উপরিভাগে এগুলো রাখলে না কেনো, যাতে লোকে দেখতে পারে। যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়।' (তিরমিজি: ১৩১৫)।
৪. মাপ বা ওজনে কম দেয়া অবৈধ
ইসলামের দৃষ্টিতে লেনদেনে মাপ বা ওজনে কম দেয়া কঠিনতম গুনাহ। কেননা
এর মাধ্যমে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। হাতের কারসাজি, দাঁড়িপাল্লায় কারচুপি, কম ওজনের বাটখারা দিয়ে ওজন করা ইত্যাদি উপায়ে লেনদেন করে ক্রেতাকে ঠকালে তার জন্য কঠিন শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে কোরআনে। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, 'যারা মাপে কম করে তাদের জন্য দুর্ভোগ। যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে তারা পুনরুত্থিত হবে সেই মহাদিবসে, যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। (সুরা মুতাফফিন: ২-৬)
৫. মিথ্যা শপথ করে বিক্রয় হারাম
লেনদেনে মিথ্যা শপথ করা থেকে বিরত থাকতে বিক্রেতাকে নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। দ্রব্যে যেই গুণ নেই তা আছে বলে বা নিকৃষ্ট বস্তুকে উৎকৃষ্ট বলে শপথ করে বিক্রি করা ইসলাম হারাম করেছে। কেননা এর মাধ্যমে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। পণ্যদ্রব্যে কোনো ত্রুটি থাকলে তা ক্রেতাকে দেখিয়ে তার সম্মতিতে কম মূল্যে বিক্রি করা যাবে। অন্যথায় তা হারাম হবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যাক্তি বাজারে পন্য আমদানী করে মহান আল্লাহ্ তা'আলার নামে কসম খেল যে, এর এতো দাম লাগানো হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা কেউ বলেনি। এতে তার উদ্দেশ্য সে যেন কোন মুসলমানকে পন্যের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলতে পারে। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়, 'যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রয় করে, আখেরাতে তাদের কোন অংশ নেই। আর তাদের সঙ্গে কেয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না। তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিও দেবেন না। আর তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। বস্তুত: তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।' (বোখারি: ১৯৫৮)।
৬. হারাম বস্তুর ব্যবসা হারাম
শরীয়তের দৃষ্টিতে যে সব বস্তু হারাম, তার ব্যবসাও হারাম। মদ, শুকর, প্রতিমা, মৃতজীব, সুদী কারবার ইত্যাদি হারাম বস্তুর ব্যবসা হারাম। একইভাবে হালাল বস্তু সাথে যদি হারাম মিশানো হয় তবে সে ব্যবসাও হারাম হবে। যেমন: ভালো চাল, ডাল বা গমের সাথে পঁচা ও ক্ষতিকর চাল, ডাল ও গম মিশিয়ে বিক্রি করলে তা হারাম হবে। হালাল ফলের সাথে মদ মিশিয়ে বিক্রি করলে তাও হারাম হয়ে যাবে। যে হালাল বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় দ্বারা হারাম কাজে সহায়তা করা হয় তাও ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। আঙ্গুর ও তার রসের ব্যবসা হালাল। কিন্তু আঙ্গুর বা রস যদি মদ তৈরির জন্য বিক্রয় করা হয় তা হলে ঐ ব্যবসা ও তা থেকে আয় হারাম হয়ে যাবে। এখানে কোরআনে সেই বাণী প্রণিধানযোগ্য যাতে বলা হয়েছে, 'সৎকর্ম ও আল্লাহ-ভীতির একে অন্যের সহযোগিতা করো। পাপ ও অন্যায় কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।' (সূরা মায়িদা: ২-৩)।
৭. মুনাফা হালাল, অস্বাভাবিক মুনাফা হারাম
ব্যবসায়ীরা মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যবসা করে। ইসলাম মুনাফা অর্জন হালাল করেছে, তবে মাত্রাধিক বা অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন হারাম করেছে। কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া, যখন তখন ইচ্ছামত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন ইসলাম অনুমোদন করে না। এমনিভাবে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় করার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করা ইসলাম হারাম করেছে। মজুদের ফলে পণ্যদ্রব্য অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। বাজারে সরবরাহের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়, দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দেয়। ফলে দ্রব্যমূল্য দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ফলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়, সমাজ জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হয়। এ জন্যই ইসলাম মজুদ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে হজরত মা'মার হতে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, 'যে লোক খাদ্য-সামগ্রী গুদামজাত করে, সে অপরাধী। সে গুনাহগার সাব্যস্ত হবে। (মুসলিম: ১৬০৫)।
সবিশেষ কথা হলো, ক্রেতা ও বিক্রেতার পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সমন্বয়ে ব্যবসা সংঘটিত হয়। তবে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহায়ক শক্তি। ব্যক্তির বহুবিধ প্রয়োজন পূরণের জন্য যেমনি ব্যবসায়ের প্রয়োজন, তেমনি পণ্যদ্রব্য বিক্রয়ের জন্য ব্যবসায়ীকে ক্রেতা-সাধারণের ওপর নির্ভর করতে হয়। কাজেই উভয়ের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মতি, সততা ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা এবং ধোঁকা, প্রতারণা, জালিয়াতি, মিথ্যা শপথ, জুলুম ইত্যাদি পরিহার করে লেনদেন করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে।
লেখক : ইমাম, শ্যামপুর কদমতলী রাজউক তাকওয়া জামে মসজিদ ঢাকা।

