জাতীয় মিম্বার থেকে
আকিদা ও শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ সমন্বয়ের নাম ইসলাম
মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল মালেক
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২২
নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অপার মেহেরবানি যে, তিনি আমাদের জীবনে আরেকটি জুমার দিন দান করেছেন। জুমার এই পবিত্র মুহূর্তে আল্লাহর ঘরে সমবেত হয়ে আমরা তাঁর হুকুম, তাঁর নসীহত ও তাঁর কিতাবের আহ্বান স্মরণ করছি। আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানের মধ্যে মুমিনদেরকে সম্বোধন করে নির্দেশ দিয়েছেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যথার্থভাবে ভয় করার মতো এবং মুসলিম না হয়ে যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০২)
এই আয়াত আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। মৃত্যু কোন সময়ে আসে, কেউ জানে না। তাই ‘আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাব’, ‘পরে শরীয়তের পথে আসব’; এই চিন্তা একজন মুমিনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মুসলিম হয়ে মরতে চাইলে সারাক্ষণ ইসলামের উপর থাকতে হবে। নিজের জীবনকে এখন থেকেই শরীয়ত ও সুন্নাহ অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে।
মানুষের একটি বড় দুর্বলতা হলো ‘কাল করবো’ বলা। অথচ ‘কাল’ শব্দটির অর্থ শুধু আগামী দিনের সূর্যোদয় নয়; ‘কাল’ বলতে কিয়ামতের দিনও বোঝায়। দুনিয়ার পুরো সময় কিয়ামতের অনন্ত জীবনের তুলনায় অতি স্বল্প। তাই গুনাহ ছাড়ার সিদ্ধান্তে কিংবা নেক আমল শুরু করার ক্ষেত্রে বিলম্ব মানেই আত্মধোঁকা। আজ না করলে হয়তো আর সুযোগই আসবে না। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই হিম্মত ও সৎ সাহস দান করেছেন। পাকা নিয়ত ও দৃঢ় ইচ্ছার এই শক্তিকেই কাজে লাগানোর নাম হলো মুজাহাদা, নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আল্লাহ বলেছেন, “যারা আমাদের পথে সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহ দেখিয়ে দিই; নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা আনকাবূত, ২৯:৬৯)
শয়তানের কুমন্ত্রণা নিয়ে মুমিন ভীত হবে না। কারণ আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, “নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল দুর্বল।” (সূরা নিসা, ৪:৭৬) শয়তান তখনই সফল হয়, যখন মানুষ ঈমানি শক্তি ব্যবহার করে না। সামান্য ধৈর্য ও অল্প কিছু মুজাহাদার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা গুনাহ ছাড়া ও হেদায়াতের পথে চলাকে সহজ করে দেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা আরেকটি মৌলিক নির্দেশ দিয়েছেন, “তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৩)
আল্লাহর রজ্জু বলতে আল-কুরআন, সুন্নাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ বোঝানো হয়েছে। সমাজে শান্তি, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ এখানেই। কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে অন্য কোথাও সত্যিকার ঐক্য পাওয়া যাবে না।
আল্লাহ অতীতের একটি দৃষ্টান্ত স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, “তোমরা সেই সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পরের শত্রু ছিলে; অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহে প্রীতি সৃষ্টি করলেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৩)
মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের দীর্ঘ দিনের শত্রæতা ইসলামের বরকতেই বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। ঈমান ও নবীর সুন্নাহ মানুষের পরিচয়কে গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠিয়ে দেয়। আল্লাহ আরও বলেছেন, “তোমরা আগুনের গর্তের কিনারায় ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের সেখান থেকে উদ্ধার করেছেন।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৩) এই মুক্তিই ইসলামের সবচেয়ে বড় নিয়ামত। কিন্তু এই নিয়ামত পাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। নিয়ামতের শোকর আদায় করতে হবে। এই শোকরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দাওয়াত ও সমাজ সংশোধনের দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হওয়া উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর তারাই সফল।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৪)
আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে বলেন, “তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিভক্ত হয়ে গেছে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৫) হক স্পষ্ট হওয়ার পর যে বিভক্তি ও ভ্রান্তির পথে চলে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তির সংবাদ দেওয়া হয়েছে। কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ চিত্রও আল্লাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, “সেদিন কিছু মুখ উজ্জ্বল হবে এবং কিছু মুখ কালো হবে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০৬-১০৭) যাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে, তারা আল্লাহর রহমতে চিরস্থায়ী জান্নাতে থাকবে। আর যারা ঈমানের পর ভ্রান্তির পথ বেছে নিয়েছে, তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা ও শাস্তি।
আসল সত্য হলো; ইসলাম কোনো আবেগী দর্শন নয়, কোনো সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণও নয়। ইসলাম হল- আকিদা ও শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ সমন্বয়। শুধু আল্লাহর নাম উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়; বরং আল্লাহ যেভাবে চান, সেভাবেই তাঁকে মানতে হবে। আল্লাহ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছি।” (সূরা মায়িদা, ৫:৩)
আকিদা সব নবীর যুগেই এক ছিল, কিন্তু শরীয়ত যুগ অনুযায়ী ভিন্ন ছিল। আখেরি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে যে শরীয়ত এসেছে, সেটিই কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরণযোগ্য। ইসলামের কিছু অংশ মানা আর কিছু অংশ বর্জন করার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, “তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশ অস্বীকার করো?” (সূরা বাকারা, ২:৮৫)
শুধু আল্লাহর নাম নেওয়াই কি ইসলাম? শুধু আল্লাহর কথা বললেই কি একজন মানুষ মুসলিম হয়ে যায়? না, ভাইয়েরা! এটা ভুল ধারণা। মক্কার মুশরিকরাও আল্লাহর নাম নিতো, আল্লাহর কথা বলতো। কিন্তু তারা মুসলিম ছিল না; তারা ছিল মুশরিক। কারণ তারা আল্লাহকে আল্লাহ যেভাবে মানতে বলেছেন, সেভাবে মানেনি। ইসলাম কেবল মুখে আল্লাহ বলা নয়। ইসলাম হলো আকিদা ও শরীয়তের সমন্বিত নাম। শুধু আকিদা থাকলেই ইসলাম পূর্ণ হয় না, আবার শুধু শরীয়তের কথাও যথেষ্ট নয়; দুটোই লাগবে।
প্রিয় ভাইয়েরা, আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবীর আকিদা এক। আল্লাহর প্রতি ঈমান, আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস, জান্নাত-জাহান্নামের বিশ্বাস; এসব আকিদা সব নবীর ক্ষেত্রে একই ছিল। কিন্তু শরীয়ত সময় ও যুগ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ছিল। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি একটি শরীয়ত ও একটি পথ নির্ধারণ করে দিয়েছি।” (সুরা মায়িদা : ৫, আয়াত : ৪৮)
প্রত্যেক যুগের মানুষ তখনই মুসলিম হিসেবে গণ্য হয়েছে, যখন তারা সেই যুগের নবীর আকিদা ও সে নবীকে দেওয়া শরীয়ত পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছে। মুসা আলাইহিস সালামের যুগে যারা ঈমান এনেছে কিন্তু মুসা আলাইহিস সালামের শরীয়ত মানেনি তারা মুসলিম ছিল না। ঈসা আলাইহিস সালামের যুগেও যারা ঈমানের কথা বলেছে কিন্তু ঈসা আলাইহিস সালামকে দেওয়া শরীয়ত গ্রহণ করেনি; তারাও মুসলিম ছিল না।
আজ আমরা আছি আখেরি নবীর উম্মত। আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে চূড়ান্ত ও সর্বশেষ শরীয়ত দান করেছেন। কুরআনের পরে আর কোনো আসমানি কিতাব আসবে না, আর কোনো নতুন শরীয়তও আসবে না কিয়ামত পর্যন্ত। এই শরীয়ত সব ভাষার, সব জাতির, সব অঞ্চলের, সব সময়ের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এখন কেউ যদি বলে, আমি আকিদা মানবো, কিন্তু শরীয়ত মানবো না; বা শরীয়তের কিছু মানবো, কিছু মানবো না; তাহলে সে ইসলামকে বিকৃত করছে।
প্রিয় ভাইয়েরা, শরিয়ত বেছে নেওয়ার মালিক মানুষ নয়; বরং আল্লাহ। কেউ যদি বলে, “আমি দেখবো শরীয়ত থেকে কী নেবো আর কী নেবো না”, তাহলে সে (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহর বিধানের উপর নিজের বিচার বসাচ্ছে। আজ কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মিষ্টি কথা বলে, সাহিত্যিক ভাষায় মানুষকে মোহিত করে, কিন্তু ইসলামী আকিদা ও শরীয়তের কথা স্পষ্ট করে বলে না। এদের কথা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না। আল্লাহর কাছে মিষ্টি কথা বা সুন্দর ভাষার কোনো দাম নেই; যদি তার পেছনে ঈমান ও শরীয়ত না থাকে।
শুধু দাড়ি থাকলেই ঈমান পূর্ণ হয় না। দাড়ি ইসলামের নিদর্শন এবং নবীদের সুন্নত; এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আকিদা শুদ্ধ না হলে, শরীয়তকে পূর্ণভাবে গ্রহণ না করলে শুধু বাহ্যিক চিহ্ন দিয়ে ঈমান রক্ষা হয় না।
প্রিয় ভাইয়েরা, ঈমান সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই ঈমান হাতছাড়া হলে দুনিয়াও বরবাদ, আখেরাতও বরবাদ। তাই ঈমান রক্ষার জন্য আমাদের সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে, বিভ্রান্ত চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক আকিদার উপর অবিচল থাকার তাওফিক দিন, পূর্ণ শরীয়ত মানার শক্তি দিন এবং ঈমানের হেফাজত করুন, আমিন।
অনুলিখন : মাওলানা কাজী ইনজামামুল হক, সহ-সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর


