ঋণ একটি বোঝা। ঋণগ্রস্ততা অনেক সময় দুশ্চিন্তা, অশান্তি ও অনৈতিকতার কারণ হয়। ঋণ প্রদান করা ভালো। তবে ঋণী হওয়া ভালো নয়। স্বাভাবিক বিবেকবুদ্ধিও একে পছন্দ করে না। ঋণী হওয়ার অর্থ হলো, নিজের কাঁধে অন্যের বোঝা বহন করা। এটি হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক, বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ তাআলা মাফ করবেন না। এজন্য বান্দার কর্তব্য, আল্লাহ তাআলার কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং দোয়া করা, তিনি যেন ঋণ ছাড়াই সব প্রয়োজন পূরণ করে দেন। অন্যের কাছে নিজেকে দায়বদ্ধ করে জীবনকে সংকটাপন্ন না করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাইতেন। এ প্রসঙ্গে দু’টি হাদীস উল্লেখ করা যায়।
১. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে এ দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই। মাসিহ দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। জীবনের ফেতনা ও মৃত্যুর ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে গোনাহ ও ঋণ থেকে আশ্রয় চাই।
কেউ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ঋণ থেকে এত বেশি আশ্রয় চান! তিনি বললেন, মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয় তখন কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৩২)
২. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুঃখ-দুশ্চিন্তা থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাবল্য এর শিকার হওয়া থেকে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৬৯) অন্য হাদীসে এসেছে, ঋণ ছাড়া শহীদের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৮৬)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মায়্যিত উপস্থিত করা হলে জিজ্ঞাসা করতেন ঋণ আছে কিনা, থাকলে পরিশোধের মত কিছু রেখে গিয়েছে কিনা। রেখে না গেলে তিনি নামাজ পড়তেন না।
সালামা ইবনুল আকওয়া রা. থেকে বর্ণিত, আমরা নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে ছিলাম। তখন একজন মায়্যিত উপস্থিত করা হল। লোকেরা তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? লোকেরা বলল, জ্বী না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? তারা বলল, জ্বী না। তখন তিনি নামায পড়ালেন। তারপর আরেকজন মায়্যিত উপস্থিত করা হল। লোকেরা তাঁকে নামাজ পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? বলা হল, জ্বী হাঁ। জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? লোকেরা বলল, তিন দিনার রেখে গিয়েছে। তখন তিনি নামায পড়ালেন। এরপর আরেকজন মায়্যিত আনা হল। লোকেরা তাঁকে নামাজ পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? তারা বলল, জ্বী না। জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? বলা হল, তিন দিনার আছে। তিনি বললেন, তোমাদের সাথীর নামাজ তোমরাই পড়। এ কথা শুনে আবু কাতাদা রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নামাজ পড়িয়ে দিন, তার ঋণ আমার জিম্মায়। তখন তিনি নামাজ পড়ালেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৮৯)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অসম্মতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হলে উম্মতের জানাজার নামাযের ব্যাপারে তাঁর যে গুরুত্ব ছিল, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এক মহিলা মসজিদে নববি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করত। হঠাৎ সে মৃত্যুবরণ করল। কিন্তু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতেন না। তার অনুপস্থিতি বোধ করলে তিনি সাহাবিদেরকে তার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তাঁরা বললেন, সে তো মৃত্যুবরণ করেছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা আমাকে জানাওনি কেন? তাঁরা আরজ করলেন, তাকে রাতে দাফন করা হয়েছিল। তখন আপনার কষ্ট হতে পারে, তাই জানানো হয়নি। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাকে তার কবরের কাছে নিয়ে চল। সেখানে গিয়ে তিনি তার জানাজার নামাজ পড়লেন এবং বললেন, এই কবরগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন, আল্লাহ আমার নামাজের ওসিলায় তা নুরানি করে দেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৫৬)
লক্ষ করুন, একজনের কাফন-দাফন, নামায সবকিছু সম্পন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু মৃত্যুসংবাদ না পৌঁছায় তিনি জানাযায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। যখন সংবাদ পৌঁছেছে তখন তার কবরের কাছে গিয়ে নামাজ পড়েছেন, যাতে আল্লাহ তাআলা তার কবরকে নুরানি করে দেন। পক্ষান্তরে আরেকজনকে তাঁর সামনে উপস্থিতই করা হয়েছে তিনি নামাজ পড়াবেন- এই উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি অসম্মত। কারণ তার উপর ঋণ আছে এবং পরিশোধের মত কিছু রেখে যাননি। এ অসম্মতির মধ্য দিয়ে তিনি উম্মতকে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, ঋণের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর! কেউই যেন বিশেষ প্রয়োজন এবং পরিশোধের প্রবল ধারণা ছাড়া ঋণ না নেয়। বিশেষ প্রয়োজনে নিলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করে দেবে। পরিশোধ না করে বা অন্তত পরিশোধ করার মত কিছু না রেখে মৃত্যুবরণ না করে।
নবীজি সা. হলেন, রাহমাতুল লিল আলামিন। তাঁর গোটা জীবন ছিল উম্মতের সর্বাঙ্গীণ শান্তি-সফলতার জন্য ব্যাকুল। সেই উম্মতেরই একজন আজ তাঁর দোয়ার মাধ্যমে বিদায় নিতে এসেছে। এবং তাঁরও ইচ্ছা ছিল, দোয়া ও সালাতের মধ্য দিয়ে তাকে শেষ বিদায় জানাবেন। কিন্তু তিনি তা করছেন না। অথচ এখনই সে এর সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী। কারণ তার উপর ঋণ আছে, যা পরিশোধের জন্য সে কিছু রেখে যায়নি এবং তাঁরও তা পরিশোধের সক্ষমতা নেই। একসময় যখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে কিছুটা সচ্ছলতা দান করলেন তখন তিনি তা নিজ জিম্মায় নিয়ে নিলেন।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দেনাদার মায়্যিত আনা হলে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, সে কি পরিশোধের জন্য কিছু রেখে গিয়েছে? রেখে গিয়েছে বললে তিনি নামাজ পড়াতেন। অন্যথায় বলতেন, তোমাদের সাথির নামাজ তোমরাই পড়। এরপর যখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিজয় দান করলেন তখন তিনি ঘোষণা করলেন, আমি মুমিনদের তাদের নিজের চেয়েও আপন। সুতরাং মুমিনদের মধ্যে যে ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করে, তা পরিশোধ করা আমার দায়িত্ব। আর যে সম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করে, তা তার ওয়ারিশদের। (সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৯৮)
অনেক সময় এমন হয়, ঋণখেলাপি ঋণ আদায় না করেই মারা গেছে। মৃত্যুর পর কোনো কারণে তা আদায় করা হয়নি। তাহলে সেটি তার পরকালীন সফলতার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হলেও ঋণ অনাদায়ী থাকলে তা জান্নাতে প্রবেশে প্রতিবন্ধক হবে বলে হাদিসে এসেছে। অন্যদিকে ঋণমুক্ত থাকা জান্নাতে প্রবেশে সহায়ক হয়।
হযরত ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার রুহ তার শরীর থেকে বের হয়ে যায় তথা ইন্তেকাল করে, আর তখন সে তিনটি বিষয় থেকে মুক্ত থাকে তথা অহংকার, সম্পদ আÍসাৎ ও ঋণ তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (জামে তিরমিজি, ১৫৭৩)
লেখক : মুহাদ্দিস, দিলু রোড মাদ্রাসা, নিউ ইস্কাটন ঢাকা।

