মানবসমাজে অন্যায় একটি চিরন্তন বাস্তবতা। ক্ষমতা, স্বার্থ ও প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বে বহু সময় মানুষের হাতে মানুষের ওপর জুলুম সংঘটিত হয়, আর এসব জুলুমের অবসান ঘটিয়ে সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায় প্রতিরোধ অপরিহার্য। ইসলাম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াকে ঈমানের দাবি হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই কেউ অন্যায় আচরণ করলে কিংবা জুলুমের শিকার হলে, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণেই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)
এই আয়াতে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ উম্মত গণ্য করা হয়েছে এবং তার কারণ কী তাও বলে দেওয়া হয়েছে। ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে নিজ নিজ জ্ঞান ও সাধ্য অনুযায়ী প্রত্যেকের ওপর ফরজ।
মুমিন প্রতিবাদ করবে। কেননা একজন সত্যিকার মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে কোথাও অন্যায় হতে দেখলে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। এমন পরিস্থিতিতে নীরব ভূমিকা ইসলাম কখনই সমর্থন করে না, বরং নিজ সাধ্য ও সামর্থ্যরে আলোকে এসব অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা এবং তা নির্মূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইমান ও ইসলামের অপরিহার্য দাবি।
সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলাম কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলেও তার প্রতিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করেছে শিষ্টাচার, নৈতিকতা ও শরয়ী সীমার দ্বারা। যেন অন্যায় প্রতিরোধ করতে গিয়ে নতুন অন্যায় সৃষ্টি না হয়—এটাই ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন সুন্নাহ’র আলোকে অন্যায় প্রতিরোধের কার্যকরী ও ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
কুরআনের দৃষ্টিতে অন্যায় প্রতিরোধ
ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থানকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ হিসেবে তুলে ধরেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দেবে; যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে বা পিতা-মাতা ও আতœীয়স্বনজদের বিরুদ্ধে হয়।” (সূরা আন-নিসা, ৪:১৩৫) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তোমরা অন্যায়ের দিকে ঝুঁকো না, তাহলে আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে।” (সূরা হূদ, ১১:১১৩) এ আয়াতগুলো প্রমাণ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়; বরং এটি ঈমানের দাবি।
হাদিসের আলোকে অন্যায় প্রতিরোধ
রাসূলুল্লাহ সা. অন্যায় প্রতিরোধের তিন স্তর নির্ধারণ করে দিয়েছেন, এরশাদ করেন- “তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখে, তবে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে মুখ দিয়ে; আর যদি তাও না পারে, তবে অন্তরে ঘৃণা করবে। আর এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর।” (সহিহ মুসলিম) এই হাদিস স্পষ্ট করে দেয় যে, প্রতিবাদেরও স্তর ও যোগ্যতা রয়েছে; ক্ষমতা, পরিস্থিতি ও পরিণতি বিবেচনা করেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইসলামে প্রতিবাদের শিষ্টাচার
ইসলাম অন্যায়ের প্রতিবাদে কয়েকটি মৌলিক নীতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
১. শালীন ভাষা ও সংযম: আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা জ্ঞানীদের সঙ্গে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করো”। (সূরা আন-নাহল, ১৬:১২৫) অর্থাৎ, প্রতিবাদ হবে শালীন, শিষ্টাচার ও প্রজ্ঞাভিত্তিক। অশ¬ীলতা, গালিগালাজ ইসলামী প্রতিবাদের অংশ নয়।
২. জুলুমের জবাবে জুলুম নয়: ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন, “জুলুম দূর করা ফরজ, তবে তা এমন পদ্ধতিতে নয় যাতে তার চেয়ে বড় জুলুম সৃষ্টি হয়।” (মাজমাউল ফাতাওয়া: ২০/৫৪)
ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, “সত্য প্রতিষ্ঠা তখনই কল্যাণকর হয়, যখন তা প্রজ্ঞা ও সংযমের সাথে উপস্থাপিত হয়।” (ইহয়াউ ঊলুমুদ্দীন: ২/৩৩১)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) দাওয়াহ-য় প্রজ্ঞায় সম্পর্কে বলেন, “তোমরা নীরব থেকেও (চরিত্র দিয়ে) আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বানকারী হও।” (শুআবুল ইমান, হাদীস: ৪২৮০)
হাসান বসরী (রহ.) বলেন, “মানুষের আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, নরম হৃদয়ের উপদেশ।” (হুলিয়াতুল আউলিয়া : ২/১৪৭) সুতরাং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা ইসলামের লক্ষ্য নয়।
৩. হিকমত ও পরিস্থিতি বিবেচনা করা: আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহ’র দিকে ডাকো হিকমত ও উত্তম উপদেশ দ্বারা।” (সুরা নাহাল ১৪:১২৫)
রাসূল সা. বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ কোমল, তিনি সব বিষয়ে কোমলতা পছন্দ করেন।” (সহীহ বুখারী: ৬০২৪, সহীহ মুসলিম :২১৬৫)
প্রতিবাদের শরয়ী সীমা
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “কোনো জাতির প্রতি তোমাদের ঘৃণা যেন তোমাদের ন্যায় থেকে বিরত না রাখে, ন্যায়বিচার করো। এটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী।” (সূরা মায়েদা, ৫:৮) সুতারং অন্যায় প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রতিশোধপরায়ণতা, প্রতিহিংসা বা অতিরিক্ত শাস্তি ইসলামে অনুমোদিত নয়।
ইসলাম স্পষ্টভাবে কিছু সীমারেখা নির্ধারণ করেছে: শাসকের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ নয় যা বৃহত্তর ফিতনা সৃষ্টি করে। এমন কর্মকাণ্ড নয়, যা নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি করে। মিথ্যা প্রচার, অপবাদ ও বিভ্রান্তিকর ভাষা পরিহার। আইন ও শরীয়তের গণ্ডির ভেতরে অবস্থান।
প্রতিবাদ হতে হবে যুক্তির আলোকে, ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু প্রতিবাদ যদি সীমাহীন হয়, তবে সমাজে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়বে। আবার প্রতিবাদ একেবারে না থাকলে, সমাজে জুলুম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিবে। ইসলাম এই দুই প্রান্তিকতার মাঝখানে ভারসাম্য রক্ষা করেছে। অর্থাৎ, প্রতিবাদ হবে সচেতন, ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ, নৈতিক ও কল্যাণমুখী। এ ভারসাম্য রক্ষা করাই ইসলামের শিক্ষা। এরই মাধ্যমে প্রতিবাদ হতে পারে কার্যকরী ও সুদূরপ্রসারী
অন্যায়ের প্রতিবাদ একজন মুসলিমের শুধু অধিকার নয়, বরং দায়িত্ব। তবে সে দায়িত্ব পালন করতে হবে শিষ্টাচার, সংযম ও শরয়ী সীমার মধ্যে থেকে। নৈতিকতা ও প্রজ্ঞা ছাড়া প্রতিবাদ সমাজে কল্যাণ নয়, বরং বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে। ইসলামের শিক্ষা হলো,অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, কিন্তু অন্যায় কারি হয়ো না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, পরিচালক, জামিয়া আরাবিয়া বায়তুস সালাম। আকুয়া চুকাইতলা, ময়মনসিংহ।

