Logo

ইসলাম

অন্যায় প্রতিহত করা কখন কর্তব্য

Icon

আব্দুল্লাহ মাসউদ

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:২৯

অন্যায় প্রতিহত করা কখন কর্তব্য

মানুষের নিরাপত্তা, সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায়-অপরাধ প্রতিহত করা অপরিহার্য। ইসলাম এই দায়িত্বকে শুধু রাষ্ট্র বা বিচারব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কর্তব্য।

নবীজি (সা.) এর বাণী- “তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখে, তবে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে মুখ দিয়ে; আর যদি তাও না পারে, তবে অন্তরে ঘৃণা করবে। আর এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর।” (মুসনাদে আহমাদ- হাদিস নং ১৯২)

সাধারণত অন্যায়-অপরাধ কোথাও না কোথাও হয়েই থাকে। সবসময় তা সকলের চোখে পড়ে না এবং সকলে জানতেও পারে না। এ অবস্থায় তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব কার? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছটির শুরুতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ দায়িত্ব ওই ব্যক্তির, যে তা জানতে পারে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে যদি জানা যায় কোথাও কোনও অন্যায় কাজ হচ্ছে, তবে মু’মিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

কারও সম্পর্কে কোনও কথা কানে আসলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর আগে ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া চাই, আসলেই সে কাজটি করেছে কি না। এজন্য পত্র পত্রিকার সংবাদ কিংবা লোকমুখে শোনা খবর যথেষ্ট নয়। এসব খবরের ভিত্তিতে প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তির সম্মানহানি বা আরও অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়, যা কোনোক্রমেই কাম্য নয়।

অপরাধ প্রতিহত করার স্তরসমূহ

হাদীছটিতে অন্যায় কাজ প্রতিহত করার তিনটি স্তর বলা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে হাত দ্বারা প্রতিহত করা। হাত দ্বারা প্রতিহত করার মানে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায়-অপরাধ দমন করা। অর্থাৎ, অন্যায় কাজটি যদি এমন হয় যা প্রতিহত করার জন্য শক্তি প্রয়োগ দরকার হয়, তবে যার শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা আছে তার কর্তব্য শক্তি প্রয়োগ দ্বারাই তা প্রতিহত করা।

দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে বাকশক্তির ব্যবহার। আর তৃতীয় হল অন্তরে ঘৃণা পোষণ। হাত ও বাকশক্তির ব্যবহার অবশ্যকর্তব্য হয় তখনই, যখন তা ব্যবহারের ক্ষমতা থাকে। যদি তা ব্যবহারের ক্ষমতা থাকে, তা সত্ত্বেও ব্যবহার করা না হয়, তবে তা দায়িত্বে অবহেলারূপে গণ্য হবে। সেজন্য আখিরাতে জবাবদিহিতার পাশাপাশি দুনিয়ায়ও শাস্তির ভয় আছে। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- কোনো কওমের মধ্যে যদি পাপাচার করা হয় আর তাদের তা প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকে, তা সত্ত্বেও প্রতিহত না করে, তবে আশঙ্কা রয়েছে আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকেই শাস্তিদান করবেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৩৮) আবূ দাউদ শরীফে আছে, এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর ইমাম শুবা রহ. বলেন, এর অর্থ অপরাধকারীগণ অপেক্ষা নিরপরাধ লোক যদি বেশি হয়।

অপরাধ দমনের প্রথম স্তর : শক্তিপ্রয়োগ

কোনো কোনো অপরাধ এমন আছে, যা দমনের জন্য শক্তিপ্রয়োগ দরকার হয়, যেমন মদের পাত্র, বাদ্যযন্ত্র, অবৈধ খেলাধুলার সামগ্রী, সিনেমা হল, নাটক-থিয়েটারের মঞ্চ, নৃত্যশালা, বেদীনী বই-পুস্তক ও দীনবিরোধী প্রচারপত্র এবং এরকম আরও যা-কিছু পাপকর্মের আসবার-উপকরণ আছে, তার উৎখাত-উৎপাটন শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়। কাজেই যাদের সে ক্ষমতা আছে তাদের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায় যে, তারা এসবের দমনে শক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মৌলিকভাবে এটা সরকারের দায়িত্ব। সরকার তার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে।

এ দায়িত্ব আমজনগণের নিজ হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। তাতে হিতে বিপরীত হয়। হাঁ, কোথাও যদি তার প্রয়োজন বোধ হয় তবে সে ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতিক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আছে। যদি সরকার নিজে ব্যবস্থা না নেয় এবং জনগণকেও ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি না দেয়, সে ক্ষেত্রে কর্তব্য জনমত গড়ে তোলা। কোনও অবস্থাতেই হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ উচিত নয়। 

শরী’আত প্রত্যেককে তার সামর্থ্য অনুপাতেই দায়িত্ব প্রদান করেছে। সে সামর্থ্যের একটা অংশ হচ্ছে সরকার বা অন্য কোনও ক্ষমতাবানদের পক্ষ থেকে বাধা না থাকা। সেরকম বাধা থাকা অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ করতে গেলে আরও বড় ক্ষতি এবং আরও বেশি অন্যায়-অপরাধ বিস্তারের আশঙ্কা থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় প্রতিরোধের দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করা, যা পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে।

অপরাধ দমনের দ্বিতীয় স্তর : বাকশক্তির ব্যবহার

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় পর্যায়ে বলেন, “যার হাত দিয়ে প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই সে প্রতিহত করবে মুখের কথা দিয়ে।” অর্থাৎ, অপরাধীকে বুঝিয়ে সমঝিয়ে অপরাধ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে। তাকে আল্লাহর ভয় দেখাবে, আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করবে এবং দরদ ও মমতার সাথে তাকে উপদেশ দেবে। প্রয়োজনে তিরস্কারও করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচ্য। সকলের জন্য সকল পন্থা উপযোগী হয় না। কেউ নরম কথায় সংশোধন হয়ে যায়, আবার কারও জন্য ধমক ও তিরস্কারই হয়। কাউকে একাকী বোঝাতে হয়, কাউকে জনসম্মুখে তিরস্কার করতে হয়। মোটকথা কাজ করতে হবে হিকমত ও বুদ্ধিমত্তার সাথে।

সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অনাচার দমনে বাহুবল ব্যবহারের অবকাশ কম। এ ক্ষেত্রে বাকশক্তিই কার্যকর। সুতরাং জানমালের ওপর আঘাত আসার আশঙ্কা না থাকলে জনগণের কর্তব্য সরকারি অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা। সেরকম আশঙ্কা থাকলে প্রতিবাদ করা জরুরি নয় বটে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যাদের জুলুম-নিপীড়ন সহ্য করার হিম্মত আছে, তারা যদি প্রতিবাদ করে তবে জিহাদের ছাওয়াব পাবে।

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “সর্বোত্তম জিহাদ জালেম শাসকের সামনে সত্য-ন্যায়ের কথা বলা।” (সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৯)

প্রকাশ থাকে যে, কলমের ব্যবহারও বাকশক্তি ব্যবহারেরই পর্যায়ভুক্ত। যার সে যোগ্যতা আছে তার কর্তব্য লেখার মাধ্যমে অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা, তা পত্র পত্রিকায় লেখার দ্বারা হোক বা বই-পুস্তক ও রচনার মাধ্যমে। যে সকল রিপোর্টার বা সাংবাদিক ইখলাস ও সততার সাথে এ কাজ করবে, তারা অবশ্যই শরী’আতের দৃষ্টিতে ‘আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার’-এর দায়িত্ব পালনকারীরূপে বিবেচিত হবে এবং এজন্য তারা বিপুল ছাওয়াবের অধিকারী হবে।

অপরাধ দমনের তৃতীয় স্তর : অন্তরে ঘৃণা পোষণ

অন্যায় প্রতিরোধের তৃতীয় স্তর হচ্ছে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করা। অর্থাৎ যখন শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকে আবার মুখের কথায়ও কাজ না হয় কিংবা মুখে বলার মত অবস্থাও না থাকে, তখন মনে মনে সে কাজকে ঘৃণা করবে এবং ওই ব্যক্তির প্রতি এই ভেবে আক্ষেপ করবে যে, আহা, সে এরূপ পাপকর্ম করে নিজের দুনিয়া আখিরাত বরবাদ করছে! সেইসঙ্গে এ নিয়তও রাখবে যে, কখনও তার শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা হলে কিংবা মুখে কিছু বলার সুযোগ হলে সে অবশ্যই সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই যে শেষোক্ত উপায় অর্থাৎ মনে মনে ঘৃণা করা, এটা সর্বাবস্থায়ই জরুরি। কেননা এর জন্য কোনও সামর্থ্যের ব্যাপার নেই। প্রথমোক্ত দুই ব্যবস্থা যেহেতু সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাই যার সে সামর্থ্য আছে কেবল সেই তা অবলম্বন করবে। কিন্তু মনে মনে ঘৃণা করার ব্যাপারটা সকলের পক্ষেই সম্ভব। তাই এটা সকলের জন্যই জরুরি।

ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর

সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এটা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। অর্থাৎ অন্যায়ের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা ঈমানের দুর্বলতম স্তর। এক বর্ণনায় আছে- “এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই।” (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫০)

এর দ্বারা বোঝা যায় অন্যায়ের প্রতি অন্তরে ঘৃণা না থাকা অন্তর থেকে ঈমান চলে যাওয়ার প্রমাণ বহন করে। এ কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ রাযি. বলেন- “ওই ব্যক্তি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যে তার অন্তরে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য অনুভব করে না।”

ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে নির্দেশ দিয়েছে। তবে শর্ত হলো- প্রজ্ঞা, শিষ্টাচার, সংযম, ন্যায়পরায়ণতা এবং সীমার মধ্যে থেকে। অন্যায়ের প্রতিরোধ এমনভাবে হতে হবে, যাতে ব্যক্তির সংশোধন হয়, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। অন্যায় প্রতিরোধের প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু ভুল ধরা নয়; বরং মানুষের হেদায়াত, সমাজের কল্যাণ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও পরিচালক, জামিয়া আরাবিয়া বায়তুস সালাম। আকুয়া চুকাইতলা, ময়মনসিংহ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর