Logo

ইসলাম

বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর করণীয়

Icon

উবায়দুল হক খান

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৪০

বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর করণীয়

আজকের বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ এক জটিল ও দ্বিধাবিভক্ত বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অগ্রগতি, বিশ্বায়ন, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। অন্যদিকে যুদ্ধ-সংঘাত, ধর্মীয় বিভাজন, নৈতিক অবক্ষয়, ইসলামফোবিয়া, দারিদ্র্য ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। যেখানে মদিনার উম্মাহ ছিল ঐক্যের প্রতীক, সেখানে আজকের উম্মাহর একাংশ দিশেহারা, বিভক্ত ও অন্তর্দ্ব›েদ্ব জর্জরিত। এমন প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর করণীয় কী; এ প্রশ্ন আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ২১ শতকের এই বৈশ্বিক বাস্তবতায় আমাদের দায়িত্ব শুধু আবেগে নয়, সুপরিকল্পিত কর্মযজ্ঞে, জ্ঞান-নৈতিকতা ও ঐক্যের ভিত্তিতে কাজ আঞ্জাম দেওয়া।

আত্মপরিচয়ে প্রত্যাবর্তন ও ঈমান মজবুতকরণ

মুসলিম উম্মাহর ভেতরকার দুর্বলতার মূল কারণ ঈমানের শৈথিল্য ও আত্মপরিচয়হীনতা। আজকের বিশ্বে আধুনিকতা ও ভোগবাদ মানুষকে ইলাহি উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তাই প্রথম করণীয় হলো- ঈমানকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিজীবন ও সমাজকে পুনর্গঠন। কোরআন-হাদিসের গভীর জ্ঞান অর্জন, দীনি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া, নামাজ-রোজা-আখলাক; এসব বিষয় মুসলিম সমাজকে অভ্যন্তরীণভাবে শক্ত করে।

ঈমান শক্ত হলে ব্যক্তি সাহসী হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে, দায়িত্বশীল হয় এবং আল্লাহর পথে আগ্রহী হয়। আধুনিক দুনিয়ার ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঈমানই মেরুদণ্ডের মতো দাঁড়ায়।

জ্ঞানের উত্থান: ইলম ও রিসার্চে বিনিয়োগ

ইসলামের প্রথম নির্দেশ ইকরা, ‘পড়া’। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় মুসলিম উম্মাহ পিছিয়ে আছে। বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি ও প্রযুক্তি যাদের হাতে, তারাই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে। তাই করণীয়- বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং, মহাকাশ গবেষণায় দক্ষতা অর্জন। ইসলামী অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বইপাঠ সংস্কৃতির প্রসার। জ্ঞান অর্জন কেবল চাকরি বা রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য নয়; বরং উম্মাহর আত্মনির্ভরতা ও নেতৃত্ব প্রত্যাবর্তনের পূর্বশর্ত।

ইসলামী অর্থনীতি ও হালাল বাণিজ্যের প্রসার

বিশ্ব রাজনীতি আজ অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া উম্মাহর স্বাধীনতা অসম্ভব। সুদভিত্তিক অর্থনীতি মুসলিম জাতিকে চিরদিন ঋণগ্রস্ত, দুর্বল ও নির্ভরশীল করে রাখে। সুতরাং করণীয়- ইসলামিক ব্যাংকিং, জাকাত, ওয়াকফ, কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্টকে শক্তিশালী করা। স্টার্টআপ, ব্যবসা ও কৃষি খাতে মুসলিম যুবকদের অংশগ্রহণ। হালাল শিল্প, প্রযুক্তি-পণ্য, খাদ্য ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে উন্নয়ন। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব কমালে উম্মাহর আত্মমর্যাদা ও বৈশ্বিক অবস্থান শক্তিশালী হবে।

নৈতিকতা, চরিত্র ও সামাজিক দায়িত্ব

আজকের সংকট কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, নৈতিক সংকটও মারাত্মক। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, অশ্লীলতা; সব জায়গায় নৈতিক পতন। অথচ রাসুল সা.-এর মিশনই ছিল চরিত্র নির্মাণ। তাই করণীয় হল- সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, দয়া, পরোপকারের চর্চা। পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিক শিক্ষা শুরু। যুবসমাজকে প্রযুক্তির অপব্যবহার ও নষ্টামি থেকে রক্ষা করা। একজন সৎ মানুষ একটি রাষ্ট্রকে বদলাতে পারে। নৈতিক মানুষই উম্মাহর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব।

মিডিয়া ও প্রযুক্তিতে দখল : সত্যের প্রচার, অপপ্রচারের মোকাবিলা

মিডিয়া এখন বিশ্বশক্তি। তথ্যযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইসলামফোবিয়া; এসব মোকাবিলা করতে না পারলে মুসলিম পরিচয় হারিয়ে যাবে। তাই প্রয়োজন ইসলামিক মিডিয়া হাউস, গবেষণা কেন্দ্র, চলচ্চিত্র ও ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি। সামাজিক মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক দাওয়াত ও প্রামাণ্য ইতিহাস প্রচার। মুসলিম সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গড়ে তোলা। হৃদয় জয়ের পাশাপাশি যুক্তিনিষ্ঠভাবে বিশ্বকে ইসলামের সৌন্দর্য দেখানো-এটাই দাওয়াহর আধুনিক রণকৌশল।

বিশ্ব মানবতার পাশে দাঁড়ানো : উম্মাহর চেতনার পুনর্জাগরণ

ইসলাম শুধু মুসলমানের জন্য নয়; সমগ্র মানবতার জন্য। রোগী, দরিদ্র, শরণার্থী, যুদ্ধাহত জনগোষ্ঠী-সবার পাশে দাঁড়ানোর নামই প্রকৃত উম্মাহর দায়িত্ব। মানবতার সেবা ইসলাম প্রচারের সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। রক্তদান, চিকিৎসা সহায়তা ও দুঃস্থদের সহযোগিতা; শিক্ষা, পানি, বাসস্থান ও আশ্রয় প্রকল্প; দুর্যোগে সক্রিয় ত্রাণ কার্যক্রম। মানবতার সেবায় নেতৃত্ব নিলে বিশ্ব আমাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাধ্য হবে।

রাজনৈতিক সচেতনতা ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা

প্রতিটি রাষ্ট্র ও সমাজ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই মুসলমানদের জাগতে হবে- ন্যায় ও নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব নির্বাচন; গণতান্ত্রিক অধিকার, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার রক্ষা; একনায়কতন্ত্র, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম; দীন ও ন্যায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে তবেই উম্মাহ উন্নতি পাবে।

পুনর্জাগরণের চাবিকাঠি

বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণ কোনো কল্পনা নয়-এটি এক বাস্তব সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার চাবিকাঠি হলো ঈমান, জ্ঞান, ঐক্য, নৈতিকতা, অর্থনৈতিক শক্তি, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও মানবকল্যাণভিত্তিক নেতৃত্ব। আমাদের প্রত্যেকে যদি নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি, বিশ্বমঞ্চে ইসলামের মর্যাদা পুনরুদ্ধার নিশ্চিত।

আজ আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা কি কেবল ইতিহাসের গৌরব নিয়ে বাঁচব, নাকি নতুন ইতিহাস লিখব? উম্মাহর প্রতিটি মানুষ যদি দায়িত্ববোধে জাগে- তবে আল্লাহর সাহায্যে পরিবর্তন অনিবার্য। ভবিষ্যৎ অপেক্ষমাণ; উত্থানও সম্ভব, যদি আমরা নিজেদের পরিবর্তন করি। [হাকিকতে ইসলাম বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম উম্মাহর করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে গত ৬ ডিসেম্বর শনিবার বাদ আসর জাতীয় প্রেসক্লাবে [জহুর হোসেন হল] প্রদত্ত বক্তৃতার বিস্তারিত আলোচনা।]

লেখক : অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর