Logo

ইসলাম

হিসাব নিকাশে জীবন

Icon

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:৫৫

হিসাব নিকাশে জীবন

মানুষের জীবন অনেকটাই হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভরশীল। আমরা দৈনন্দিন জীবনে নানা সিদ্ধান্ত নেই, এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তে হিসাব রাখা অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা কোরআনে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন:-আল্লাহ প্রতিটি ছোট ও বড় কৃত্যের হিসাব রাখেন (সূরা আল-মুজাদালাহ: ৭)। এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনের প্রতিটি কাজ-সাধারণ বা গুরুতর- আল্লাহর নজরের বাইরে নয়। আমাদের প্রতিটি কর্ম লিপিবদ্ধ হয়, এবং একদিন আল্লাহর কাছে এর পূর্ণ হিসাব দিতে হবে।

মানুষ স্বভাবতই গণনা ও হিসাব রাখে। ছোটবেলা থেকেই আমরা সংখ্যা শিখি- এক, দুই, তিন। এটি শুধু শিক্ষার অংশ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতে সাহায্য করে। দৈনন্দিন জীবনে যেমন বাজেট তৈরি করা, কেনাকাটা করা, সময়ের সঠিক ব্যবহার-সব ক্ষেত্রেই হিসাব অপরিহার্য। হিসাব রাখার এই অভ্যাস আমাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল এবং পরিকল্পিত করে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “মৃত্যুর আগে তোমরা তোমার আত্মার হিসাব নাও” (জামে তিরমিজি: ২৪১৭)। এই হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, শুধুমাত্র জগতের কাজে নয়, আত্মার দিকে তাকিয়েও হিসাব রাখা জরুরি। আমরা আমাদের আচরণ, সময়, সম্পদ এবং প্রয়াস পর্যালোচনা করি যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আত্ম-পর্যালোচনা আমাদের নৈতিকতা এবং চরিত্রের উন্নয়নে সহায়ক।

গণনা বা হিসাব রাখার গুরুত্ব কেবল ব্যক্তিগত নয়; এটি সামাজিক এবং মানসিক দিকেও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখি কতজনকে সাহায্য করেছি, কতজন প্রয়াস সফল হয়েছে, অথবা কোনো অনুষ্ঠানে কতজন উপস্থিত ছিলেন। এই তথ্য আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সুবিন্যস্ত করে এবং জীবনে নিয়মিততা আনে। একজন মানুষ যে দায়িত্ব পালন করে, তা হিসাবের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা যায়।

আল্লাহর সামনে হিসাব রাখা কেবল রোজগারের হিসাব নয়, বরং আত্মার হিসাবও গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে বলা হয়েছে: “আর তোমরা যা কিছু ভালো করো, আল্লাহ তা জানেন” (সূরা আল-বাকারা: ২৭১)। আমরা যখন আমাদের কাজগুলোকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করি, তখন সেই কাজ শুধুমাত্র আমাদের জন্য নয়, বরং আগামী জীবনের জন্যও পুণ্য সঞ্চয় হয়।

জীবনের হিসাব-নিকাশে আমরা শুধু সংখ্যা বা কর্মের তালিকা দেখি না। আমাদের মানসিকতা, সততা, এবং দায়িত্বশীলতা হিসাবের অংশ। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি কাউকে সাহায্য করি, শুধু দানের পরিমাণ নয়, সাহায্যের মানসিকতা ও উদ্দেশ্যও আল্লাহ হিসাব করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে দান করে, আল্লাহ তার জন্য বহুগুণ পুরস্কার নির্ধারণ করবেন” (বুখারি: ১৪০৩)। একজন শিক্ষক তার ছাত্রদের প্রতি যতœবান হলে, তা শুধুমাত্র শিক্ষার অংশ নয়, বরং আল্লাহর চোখে একটি বড় কর্ম।

অতএব, হিসাব-নিকাশ শুধু সংখ্যার খাতা নয়; এটি আমাদের আত্মপরিচয়, নৈতিকতা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। প্রতিদিন আমাদের নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত- আমি কি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করছি? আমার সময়, ক্ষমতা ও সম্পদ কি সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে? এই প্রক্রিয়াই মানুষকে আত্মসংযম, মননশীলতা এবং আত্মোন্নতির দিকে নিয়ে যায়।

আরও একটি হাদিসে বলা হয়েছে: “প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতিদিনের কর্মের জন্য জিজ্ঞাসা করা হবে” (মুসনাদ আহমদ: ১৯৮৭)। এই হাদিস আমাদের মনে করায় যে, আমরা যতই ছোট বা বড় কাজ করি, সবই আল্লাহর কাছে রেকর্ড হয়। সুতরাং প্রতিটি কাজ সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত।

কোরআনে আরও নির্দেশ রয়েছে: “যে ব্যক্তি কোনো সৎ কাজ করে, তার জন্য সোনার সমান বা তার চেয়ে বেশি পুরস্কার রয়েছে” (সূরা আন-নিসা: ১২৩)। এটি আমাদের নিশ্চিত করে যে, প্রতিটি ভালো কাজ- আপনি যতই ছোট মনে করেন না কেন- মূল্যবান এবং আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।

পরিশেষে বলতে চাই , জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই হিসাবের মধ্যে রয়েছে। আমাদের প্রতিটি কাজ, সিদ্ধান্ত ও প্রয়াস আল্লাহর চোখে রেকর্ড হয়। আমরা যখন সচেতনভাবে হিসাব রাখি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করি, তখন আমাদের জীবন শুধুমাত্র সফল নয়, বরং পরকালের জন্যও প্রস্তুত হয়। হিসাব-নিকাশ আমাদের আত্মসংযম, নৈতিকতা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক অবিচ্ছেদ্য মাধ্যম।

লেখক : কলাম লেখক ও  ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর