তাওহীদের আহ্বান
‘তাওহীদ হলো মানবতার মুক্তির ঘোষণা’- এ ঘোষণা প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর আগমনের পূর্বে আরব সমাজ ছিল গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত; বহু দেবতার পূজা, সামাজিক অবিচার, মানবিকতার চূড়ান্ত অবক্ষয় মানুষের আত্মাকে বন্দি করে রেখেছিল। এমন কঠিন সময়ে নবীজি (সা.) এক আকাশছোঁয়া আহ্বান নিয়ে আসেন- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” এর অর্থ শুধু একটি বাক্য নয়; এটি ছিল মানুষের মন, সমাজ ও সভ্যতায় বিপ্লবের সূচনা। তাওহীদ মানুষকে শিখিয়েছে-শুধু আল্লাহই মহান, অন্য সব ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবন, কথা ও আচরণের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন, এক আল্লাহর ইবাদতই মানুষের আসল স্বাধীনতা। তিনি শেখালেন- মানুষের মধ্যে বিভাজন দূর হয় যখন সবাই এক সৃষ্টিকর্তার বান্দা হিসেবে নিজেদের জানে। তাওহীদ মানুষকে অহংকার থেকে উদ্ধার করে, ভয় থেকে মুক্তি দেয়, মানুষের মর্যাদা সমুন্নত করে। এই আহ্বান শুধু ধর্মীয় নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক দর্শন, যা মানুষকে পরিশুদ্ধ করে এবং সব ধরনের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে। তাই তিনি বিশ্বের তাওহীদের মুর্শিদ-মানুষকে একমাত্র সত্যের পথে ডাক দেওয়া শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক।
নৈতিকতার আলো
মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন নৈতিকতার জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তিনি বলেননি যে মানুষ ভালো হোক; বরং নিজেই প্রথমে ভালো হয়ে দেখিয়েছেন। তাঁর সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও সততা এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে, শত্রæরাও তাঁকে “আল-আমিন” ও “আস-সাদিক” নামে ডাকত। মানুষের চরিত্র যখন ভেঙে পড়েছিল, তখন তিনি দেখিয়ে দিলেন-একজন মানুষ কীভাবে সরলতা, আন্তরিকতা ও ন্যায়বোধ নিয়ে জীবনযাপন করতে পারে। তাঁর নৈতিকতা ছিল এমন, যেখানে শত্রæকেও প্রতিহিংসার বদলে উদারতা দেওয়া হতো। নবীজী (সা.) বলেছেন, “সেরা মানুষ সে, যার চরিত্র সেরা।” এই শিক্ষা আজও আমাদের জন্য পথনির্দেশ। সমাজের অবক্ষয়ের এই যুগে তাঁর নৈতিক আদর্শই পারে মানুষকে সত্য পথে ফিরিয়ে আনতে। ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার, রাজনীতি, বিচার-জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তাঁর সততার আদর্শই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। নৈতিকতার এই দীপ্ত আলো মানবসভ্যতায় চিরকাল উজ্জ্বল থাকবে।
দয়ার প্রতিমূর্তি
কোরআন নবীজী (সা.)-কে ঘোষণা করেছে-“সমগ্র পৃথিবীর জন্য রহমত।” তাঁর দয়া ছিল অশেষ, সীমাহীন ও নিখাদ। তিনি কখনো মানুষের কষ্ট দেখলেই উদাসীন থাকতেন না। এতিমদের মাথায় ¯েœহের হাত রাখতেন, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, ক্ষুধার্তদের আহার দিতেন। তাঁর শত্রæরাও তাঁর দয়ার কারণে শান্তি পেত। তাইফের ঘটনায় যখন তাঁকে রক্তাক্ত করা হয়েছিল, তখন প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু তিনি দোয়া করেছিলেন-“হে আল্লাহ! এরা জানে না, তাই এরা এমন করছে। তাদের হেদায়েত দাও।” এমন দয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাঁর দয়া শুধু মানুষের প্রতি নয়; পশু–পাখি ও প্রকৃতির প্রতিও ছিল গভীর। তিনি গাছ কেটে ফেলা নিরুৎসাহিত করতেন, পশুদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপাতে নিষেধ করতেন। আজকের বিশ্বে হিংসা–বিদ্বেষ যখন বেড়ে যাচ্ছে, তাঁর দয়ার শিক্ষা মানুষকে ঐক্য, শান্তি ও সহমর্মিতার পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। তাঁর দয়া মানুষকে মানুষ হতে শেখায়-এটাই তাঁর শিক্ষা।
নেতৃত্বের আদর্শ
নবীজী (সা.)-এর নেতৃত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। তিনি কখনো সিংহাসনে বসে শাসন করেননি, বরং মানুষের মধ্যে মিশে ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বের মূল ছিল- সেবা, ন্যায় ও পরামর্শ। যুদ্ধের ময়দানে তিনি থাকতেন সামনের সারিতে, আর শান্তির সময়ে থাকতেন মানুষের সেবায়। তাঁর নেতৃত্ব মানুষকে ভীতি নয়, ভালোবাসা ও আস্থা দিতো। বদর, উহুদ, হুনাইন- সব যুদ্ধেই তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, নেতা মানে অহংকার নয়, বরং বিনয় ও সাহস। তিনি মুসলমানদের শিখিয়েছেন, নেতার কাজ হলো দায়িত্ব গ্রহণ করা, সম্মান আদায় করা নয়। নবীর নেতৃত্বের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল শূরা-পরামর্শ। তিনি সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতেন পরামর্শের ভিত্তিতে, যা আজকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও মূল নীতি। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল এমন একটি সমাজ যেখানে দুর্বলও ছিল নিরাপদ, আর শক্তিশালীও আইন মানতে বাধ্য। এ নেতৃত্ব আজও আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার আদর্শ হতে পারে।
সমাজ নির্মাণ শিক্ষা
নবীজী (সা.)- এর আগমন শুধু ধর্মীয় পরিবর্তন নয়, সামাজিক পরিবর্তনের বিপ্লবও বয়ে এনেছিল। তিনি মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করেছেন তাকওয়া ও নৈতিকতার ভিত্তিতে- জাতি, বর্ণ, গোত্র বা ধনসম্পদ দিয়ে নয়। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক অনন্য সমাজব্যবস্থা, যেখানে ন্যায়, সাম্য ও মানবতা ছিল মূল স্তম্ভ। মদিনায় তিনি গড়েছিলেন আদর্শ রাষ্ট্র, যেখানে মুসলিম-অমুসলিম সবাই সমান অধিকার পেত। সমাজের দরিদ্র, এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধী-সবার অভিভাবক ছিলেন তিনি। তিনি বলেছেন, “যে প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করে না, সে প্রকৃত মুমিন নয়।” পরিবারের ভাঙন রোধে, সমাজে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তাঁর শিক্ষা ছিল মূলভিত্তি। তিনি নারীকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন, তাদের শিক্ষা, সম্পত্তির অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এমন সমাজব্যবস্থা মানবসভ্যতার ইতিহাসে তুলনাহীন। আজকের বিশ্বে বৈষম্য, সহিংসতা ও অবিচার দূর করতে তাঁর শিক্ষা অপরিহার্য।
জ্ঞানের আলোছায়া
নবীজী (সা.) শিক্ষাদান করেছেন- জ্ঞানই মানুষের উত্তরণের পথ। প্রথম ওহি- “পড়ো”-এর মাধ্যমে তিনি জ্ঞান ও শিক্ষাকে ইমানের অংশ বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ।” তাঁর শিক্ষা শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়; চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কৃষি, প্রশাসন-সবই ছিল তাঁর দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। তিনি একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যার ফলাফল ছিল পরবর্তী কয়েক শতকের ইসলামী স্বর্ণযুগ। তিনি জ্ঞানকে মানুষের হৃদয়ে আলো হিসেবে দেখেছেন- যা অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অমানবিকতা দূর করতে পারে। আজকের যুগে যখন অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি বাড়ছে, তাঁর জ্ঞানচর্চার আহ্বান আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি দেখিয়েছিলেন, জ্ঞান অর্জন মানে শুধু মুখস্থ করা নয়; তা হচ্ছে জীবনকে আলোকিত করা এবং অন্যের উপকারে লাগানো। তাঁর এই শিক্ষা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
শান্তির দিশা
নবীজী (সা.) শান্তির দূত। তাঁর পুরো জীবন শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অতিবাহিত। মদিনায় আসার পর তিনি বিভিন্ন গোত্র, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে শান্তির চুক্তি করেন-মদিনা সনদ। তিনি শিখিয়েছেন- প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত ও জিহ্বা থেকে মানুষ নিরাপদ থাকে। যুদ্ধ কখনোই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না; বরং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তাঁর শিক্ষা হলো- যেখানে সম্ভব শান্তির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। তিনি হুদাইবিয়ার চুক্তিতে অসাধারণ ধৈর্য দেখিয়ে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি এনেছিলেন। আজকের বিশ্বে যখন সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সংঘাত বাড়ছে, তাঁর শান্তির দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বকে আলোকিত করতে পারে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন-শান্তি শুধু কথা নয়; তা হলো অভ্যন্তরীণ শান্তি, সামাজিক শান্তি এবং মানবতার প্রতি গভীর সম্মান।
চিরন্তন পথপ্রদর্শক
মুহাম্মদ (সা.)- এর শিক্ষা শুধু ১৪০০ বছর আগের মানুষের জন্য নয়; তিনি সব যুগের প্রিয় নবী। তাঁর শিক্ষা সার্বজনীন, কালজয়ী ও মানবিক। আধুনিক সমাজ যত অগ্রসর হচ্ছে, ততই নবীজীর আদর্শ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। কারণ তাঁর শিক্ষায় আছে শান্তি, ন্যায়, সভ্যতা, দয়া, জ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবতা- যা আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তিনি আমাদের তাওহীদের মুর্শিদ-যিনি মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত, পরিশুদ্ধ জীবন ও সত্যের পথে ডাক দিয়েছেন। তাঁর অনুসরণে যেমন হৃদয় আলোকিত হয়, তেমনি সমাজ হয় শুদ্ধ, ন্যায়বিচার হয় প্রতিষ্ঠিত, বিশ্ব হয় শান্তিময়। তিনি এমন এক আলোকবর্তিকা, যার আলো কখনো নিভে না। তাই তাঁর শিক্ষা আমাদের জীবনের দিশা, তাঁর অনুসরণ আমাদের মুক্তির পথ, আর তাঁর ভালোবাসা আমাদের ঈমানের সৌন্দর্য। তিনি চিরন্তন পথপ্রদর্শক- স্রষ্টার পক্ষ থেকে মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।
লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

