শহীদরা মরে না- এই বাক্যটি কোনো শ্লোগান নয়, এটি এক অনন্ত সত্যের প্রতিধ্বনি। রক্তে ভেজা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে যে মানুষটি জীবনকে বিলিয়ে দেয় ন্যায়ের পক্ষে, তার নিঃশ্বাস থেমে গেলেও তার উপস্থিতি থামে না। সে থেকে যায় সময়ের শিরায়, স্মৃতির ধমনিতে, ইতিহাসের নীল পাতায়। শহীদের মৃত্যু নেই- আছে কেবল রূপান্তর; দেহের সীমা পেরিয়ে আত্মার বিস্তার। যখন বন্দুকের নল অন্ধকারকে চুমু খায়, যখন অন্যায়ের ছায়া লম্বা হয়, তখনই শহীদের নাম উচ্চারিত হয় বাতাসে।
শহীদ মানে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা সাহস, ভয়ের কপালে লেখা অস্বীকৃতি। সে জানে- পেছনে ফেরা নেই; তবু সামনে এগোয়। তার পা মাটিতে, চোখ আকাশে। সে বুঝে নেয়, জীবন শুধু নিজের নয়; জীবন হলো আমানত, ন্যায়ের জন্যই তা ব্যয় হয়। শহীদের রক্ত শব্দহীন ভাষায় কথা বলে। সে ভাষা শোনে নিপীড়িতের বুক, শোনে অনাগত প্রজন্ম। সেই রক্তের ফোঁটায় লেখা থাকে প্রতিজ্ঞা-অন্যায় স্থায়ী নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেখানেই সত্যকে চাপা দেওয়া হয়েছে, সেখানেই কোনো না কোনো শহীদ আলো জ্বালিয়েছে। আলো জ্বালানো মানে বেঁচে থাকা; আলো জ্বালানো মানে অমর হওয়া।
পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা অনুভব করতে পার না। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৫৪)
আল্লাহর বাণী আমাদের শেখায়, শহীদরা মৃত নয়; তারা জীবিত, তবে আমাদের উপলব্ধির বাইরে। আল- কোরআন-এর এই ঘোষণা শহীদের জীবনের ব্যাখ্যা দেয়- এ জীবন চোখে দেখা যায় না, তবু হৃদয়ে অনুভূত হয়। শহীদের হাসি হয়তো ছবিতে আটকে থাকে, কিন্তু তার আদর্শ হাঁটে রাস্তায়, দাঁড়ায় প্রতিবাদে, বসে থাকে শিক্ষালয়ের বেঞ্চিতে।
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘শহীদদের রুহ সবুজ পাখির মাঝে প্রতিস্থাপন করা হয়, ফলে তারা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। তারপর তারা আরশের নিচে অবস্থিত কিছু ঝাড়বাতির মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন তাদের রব তাদের প্রতি এক দৃষ্টি দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কী চাও? তারা বলে হে রব! আমরা কী চাইতে পারি? আমাদেরকে যা দিয়েছেন তা তো আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে দেননি। তারপরও তাদের রব আবার তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে একই প্রশ্ন করেন। যখন তারা বুঝল যে, তাদের কিছু চাইতেই হবে, তখন তারা বলে, আমরা চাই আপনি আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনে ফেরত পাঠান, যাতে আমরা পুনরায় আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হতে পারি। শহীদগণের সওয়াবের আধিক্য দেখেই তারা এ কথা বলবে- তখন তাদের মহান রব তাদের বলবেন, আমি এটা পূর্বে নির্ধারিত করে নিয়েছি যে, এখান থেকে আর ফেরার কোনো সুযোগ নেই। (মুসলিম: ১৮৮৭)
কারবালার প্রান্তরে দাঁড়িয়ে যে শিক্ষা লেখা হয়েছিল, তা আজও মুছে যায়নি। কারবালা আমাদের শিখিয়েছে- সংখ্যা নয়, সত্যই বিজয়ী। ইমাম হুসাইন-এর আত্মত্যাগ প্রমাণ করেছে, মাথা নত না করেও ইতিহাস বদলানো যায়। সেই শিক্ষা কেবল ধর্মের নয়; তা মানবতার। শহীদরা মরে না, কারণ তারা ভয়কে পরাজিত করে যায়। ভয় বাঁচে দীর্ঘদিন, কিন্তু সত্য বাঁচে চিরকাল। শহীদের মৃত্যু আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়- আমরা কী বেছে নেব? নীরব নিরাপত্তা, না ঝুঁকিপূর্ণ ন্যায়? এই প্রশ্নই শহীদের উত্তরাধিকার। শেষ পর্যন্ত শহীদরা আমাদের হাতে তুলে দেয় এক দায়িত-স্মরণ করার নয়, ধারণ করার। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যথেষ্ট নয়; তাদের আদর্শকে দৈনন্দিন আচরণে রূপ দিতে হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, দুর্বলের পাশে দাঁড়ানো, সত্যের পক্ষে অটল থাকা-এগুলোই শহীদের জীবনের ধারাবাহিকতা।
শহীদরা মরে না। তারা বাতাসে মিশে যায়, আলো হয়ে ফেরে, বিবেক হয়ে জাগে। তাদের নাম মুছা যায় না। কারণ তারা নাম নয়, তারা পথ।
লেখক : সম্পাদক, প্রতিভা

