রাগ, দুঃখ, আনন্দ এগুলো আমাদের মানবিক চরিত্রের অংশ। মানুষ হিসেবে আমাদের রাগ উঠতেই পারে। কিন্তু নিজের রাগকে সংযত রাখা একজন প্রকৃত মুমিনের অন্যতম গুণাবলী। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এই গুণের প্রশংসা করেন এবং যারা নিজেদের রাগ সংযত করে, তাদের জন্য তিনটি পুরস্কারের ঘোষণা দেন। সেগুলো হলো:
১. ক্ষমা করে দিবেন।
২. জান্নাত দান করবেন।
৩. মুত্তাকিদের অন্তর্ভুক্ত করবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমিনের সমান; যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। (এগুলো তাদের জন্য) যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং রাগ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।” [সূরা আলে-ইমরান ৩: ১৩৩-১৩৪]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে, তা অন্য কিছু সংবরণে নেই।” [সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪১৮৯]
যেমন ধরুন, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পিপাসার্ত অবস্থায় আপনি যদি একগøাস ঠাণ্ডা পানি পান করেন, তখন আপনার কেমন লাগবে? আপনি কতোটা সন্তুষ্ট হবেন? ঠিক তেমনি, আপনার যদি রাগ উঠে আর আপনি সেটা সংবরণ করেন, তাহলে আল্লাহ তা’আলাও অত্যন্ত সন্তুষ্ট হবেন।
যে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে, সে মূলত তিনটি শক্তির ওপর বিজয়ী হয়। সেগুলো হলো:
এক. নিজের নফসকে পরাজিত করে। দুই. নিজের সাথে থাকা শয়তানকে পরাজিত করে। তিন. তাকে যে রাগান্বিত করে, ঐ লোকটির সাথে থাকা শয়তানকেও পরাজিত করে।
তারমানে আপনি যদি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলে আপনি এক ঢিলে তিনটি পাখি শিকার করলেন! আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী পড়লে অবাক হবেন। দেখবেন তাঁর জীবনে এতো এতো ঘটনা ঘটেছে, রাগান্বিত হবার মতো এতো এতো কারণ ছিলো, কিন্তু তিনি নিজের রাগকে ঐভাবে প্রকাশ করেননি। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সাহাবীরা তাঁর চেহারা দেখে বুঝতে পারতেন যে, তিনি রাগ করেছেন; কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো কাজের মধ্যে তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন না।
কেউ কেউ বলতে পারেন, ‘আমি বদমেজাজী। আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমার কী করার আছে!’ তাদের জন্য উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনিও গরম মেজাজের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু খলিফা হবার পর তিনি আগের মতো কঠোর ছিলেন না, তিনি তাঁর রাগ নিয়ন্ত্রণ করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে আমরা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? এরজন্য কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।
১। দু’আ করা:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি এমন একটা দু’আ জানি, যেটা পড়লে রাগ দূর হয়ে যাবে।” দু’আটি হলো-‘আ’উযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বান’। [সহীহ বুখারী: ৩২৮২]
এটা হলো রাগ কমানোর দু’আ। কেউ যদি রাগের মধ্যে এই দু’আটি পড়ে, আল্লাহ তার রাগ কমিয়ে দিবেন।
২। ওজু করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “রাগ আসে শয়তান থেকে। শয়তানকে আগুন থেকে তৈরি করা হয়েছে। অতএব, তোমাদের কারো রাগ হলে সে যেনো ওজু করে নেয়।” [সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৮৪]
৩। কাজ কমিয়ে দেওয়া:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের কেউ যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত হয়, সে যেন বসে পড়ে। এতে যদি তার রাগ কমে, তাহলে তো ভালো; অন্যথায় সে যেন শুয়ে পড়ে।” [সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৮২]
৪। নীরবতা অবলম্বন:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ রাগান্বিত হলে সে যেনো নীরবতা অবলম্বন করে।” [ইমাম বুখারী, আদাবুল মুফরাদ: ২৪৪]
সুন্নাহর আলোকে রাগ নিয়ন্ত্রণের এই চারটি পদ্ধতি পাওয়া যায়। মনোবিজ্ঞানীরা আরেকটি পদ্ধতির কথা বলেন। সেটা হলো- কোন কাজটির ফলে আপনি রাগান্বিত হতেন, সেটা উপলব্ধি করা। যে কাজটির ফলে আপনি রাগান্বিত হন, সেটা কমিয়ে দেয়া বা না করা।
মনে করুন, ফেসবুকে কারো পোস্ট পড়লে আপনার রাগ উঠে। যতোবার তার পোস্ট চোখের সামনে আসে, ততোবার আপনি রাগে ফেটে পড়েন। এক্ষেত্রে আপনার করণীয় হলো সেই ব্যক্তিকে ‘আনফলো’ করা। তার পোস্ট পড়ার দরকার কী বা তার ভিডিও দেখার দরকার কী?
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “যদি কোনো মানুষকে যাচাই করতে হয়, সে যখন শান্ত থাকে তখন যাচাই কোরো না। বরং সে যখন রাগান্বিত হয়, তখন যাচাই কোরো।”
অর্থাৎ, একজন রাগান্বিত মানুষের আচরণ বলে দেয় সে কেমন মানুষ, তার মধ্যে নীতি-নৈতিকতাবোধ কেমন। ঠাণ্ডা মাথায় আপনি নীটি-নৈতিকতা, আদব-আখলাক শিখলেন। কিন্তু, এগুলো যখন প্রয়োগ করার সময় আসে, তখন যদি আপনি উত্তেজিত হয়ে অনৈতিক কাজ করেন, বেয়াদবি করেন, তাহলে মুখস্থ নীতি-নৈতিকতা শিখে তো আপনার কোনো লাভ হলো না। রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না, কিন্তু যদি আমরা সেটা সংবরণ করতে পারি, তখনই আমরা জিতে যাবো শয়তানের উপর, জিতে যাবো নিজের নফসের উপর। এই রাগের কারণে অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, চাচা-ভাতিজার মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ন দেখা দেয়। আমরা যদি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে এমনটা হবে না। যদি কখনো রাগ উঠে যায়, তাহলে সুন্নাহতে বর্ণিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে পারি। যদি আমরা নিজেদের রাগ হজম করে চলতে পারি তাহলে আমরা হতে পারবো আল্লাহ তা’আলার ঘোষিত সেই পুরষ্কারের অধিকারী। তখন উভয় জাহানের সফলতা আমাদের পদচুম্বন করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর ইসলামী আইন বিভাগ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা

