সোশ্যাল মিডিয়া : সংবাদ যাচাই করা দ্বীনি দায়িত্ব
মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১৮
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, "হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো দুষ্কৃতকারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তা যাচাই-বাছাই করে নেবে। যেন অজ্ঞতাবশত কাউকে ক্ষতি করে পরে অনুতপ্ত হতে না হয়।" (সূরা আল-হুজুরাত: ৬)
আল্লাহর এই কালাম শুধু একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা নয়, এটি প্রতিদিনের জীবনের এক অনন্য দিকনির্দেশ। আজকের ডিজিটাল যুগে এর প্রয়োজনীয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, এখন তথ্যের স্রোত এমন ভয়াবহ গতিতে প্রবাহিত হয় যে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য না করলে মানুষ মুহূর্তেই ধোঁকার শিকার হতে পারে।
সত্যতা যাচাই দ্বীনের অপরিহার্য নির্দেশ
ইসলাম মানুষের আখলাক নির্মাণের বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্বারূপ করে। ধর্মীয় হোক বা দুনিয়াবি, যে কোনো সংবাদ শোনা মাত্রই তা বিশ্বাস করে নেয়া কখনোই ইসলামের শিক্ষা নয়। কারণ, ভুল সংবাদ ভেঙে দিতে পারে বিশ্বাস, নষ্ট করতে পারে সম্পর্ক, এমনকি ধ্বংস করে দিতে পারে পরিবার ও সমাজের শান্তি।
এজন্য সর্বপ্রথম প্রশ্নটি হওয়া উচিত, তথ্যদাতা কে? তার জীবনাচার, আদব আখলাক, সত্যবাদিতা এসব যাচাই করা জরুরি। এমন হতে পারে, সে সামান্য কথাকে নিজের স্বার্থে পাহাড় বানিয়ে সামনে তুলে ধরে। যেমন একটি বেলুন দূর থেকে বিশাল দেখায়, কিন্তু সামান্য সূচ ফোটালেই কেবল রাবারের টুকরো। বহু কথাই এমন থাকে যা দেখতে বড়, আসলে তা তুচ্ছ।
শেখ সাদি (রহ.) বলেছেন: "যে ব্যক্তি তোমার কাছে এসে অন্যের গিবত করে, সে অন্যদের কাছে গিয়ে তোমার গিবতও করবে।" অর্থাৎ, যে মানুষের স্বভাবই অপনা-অপনির কথা বয়ে বেড়ানো, তার কথায় কান দিলে সম্পর্ক ভেঙে যায়, সমাজে বিদ্বেষ জন্মায়।
মিথ্যা প্রচার, এক ভয়াবহ রোগ
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।" (সহিহ মুসলিম-৫) যেন এই হাদিসটি আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য যেন বিশেষভাবে ঘোষিত হয়েছে। এখন তো এক ক্লিকেই হাজারো মানুষ ভুল তথ্য পেয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বরং বানোওয়াট হাদিস ছড়িয়ে যায়। সালাফের নামে অগণিত মনগড়া বাণী ভাইরাল হয়। কোরআনের আয়াতের মনগড়া অনুবাদ ছড়িয়ে যায় অথচ গেররআনে তার অস্তিত্বই নেই। এভাবে দ্বীনের নামে মিথ্যা প্রচার করা সাধারণ কোন অপরাধ নয়; তা গুরুতর গুনাহ। রাসূল (সা.) সতর্ক করে বলেছেন: "যে ইচ্ছে করে আমার উপর মিথ্যারোপ করে সে যেন জাহান্নামে তার আসন বানিয়ে নেয়।" (সহিহ বুখারি-৩৪৬১)
বিভ্রান্তিকর ওয়েবসাইট, ইমানের ওপর আঘাতের নতুন রূপ
অনেকে ভালো উদ্দেশ্যে ইন্টারনেটে দ্বীনি কিতাবাদি খোঁজ করেন। আর এখানে শুধু নাম দেখে বিশ্বাস করলে বড় ধোঁকার শিকার হতে হয়। "আল-ইসলাম, আল ইলম" বা এ জাতীয় সুন্দর সুন্দর নামের আড়ালে অনেক সাইটই বিভিন্ন বাতিল ফেরকা কর্তৃক পরিচালিত। যারা অতি কৌশলে ভ্রান্ত মতাদর্শের দিকে টেনে নেয়।
এজন্য দ্বীনি বিষয় জানতে হলে হক্কানি আলেমদের বা নির্ভরযোগ্য কোন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়া অতীব জরুরী।
এআই, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির নতুন চ্যালেঞ্জ
এআই (Artificial Intelligence)- আজ অনেকের তথ্য সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু জানা থাকে আবশ্যক যে, এআই- এর বিশাল সীমাবদ্ধতা আছে। এটি আকীদা-বিশ্বাস যাচাই করতে জানে না। সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যও করে না। যার লেখা অনলাইনে বেশী পরিমাণ, সেটিকেই "সত্য" ধরে নেয়। ফলে বাতিল ফেরকার লেখা সমূহ এআই- এর কাছে "ইসলামি তথ্য"। ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মতামত তার নিকট "তাফসির/হাদিসের ব্যাখ্যা"। হক্কানি আলেমের সহিহ মতামত ইন্টারনেটে না থাকলে এআই তা চিনেই না। তাই, এআইকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা মানে, ভ্রান্ত মতাদর্শের দাস হয়ে যাওয়া বৈ কিছুই নয়।
এআই-নির্মিত ভিডিও ও দৃশ্যমান সত্যের সংকট দীর্ঘকাল ধরে মানবসমাজ একটি মৌলিক অনুমানকে নির্ভরতার সাথে গ্রহণ করে এসেছে। এতদিন পর্যন্ত, ভিডিও ছিল মানুষের নিকট চোখে দেখা সত্যের অন্যতম নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। দৃশ্যমান তথ্যের প্রত্যক্ষতা এবং পুনরুৎপাদন অসম্ভব হওয়ার কারণে ভিডিও নথিকে বিভিন্ন মহলে সার্বিক জনমত গঠনের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো।
কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও)-নির্ভর ভিডিও সৃজন ও সম্পাদনা প্রচলিত এই ধারণাকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আধুনিক জেনারেটিভ মডেলসমূহ এখন এমন ক্ষমতা অর্জন করেছে যে, কণ্ঠস্বর নিখুঁতভাবে পরিবর্তন করা, মুখচ্ছবি প্রতিস্থাপন বা রূপান্তর, পরিবেশ ও দৃশ্যপট সম্পূর্ণ নতুন করে নির্মাণ, এমনকি সম্পূর্ণ নতুন চরিত্র ও পরিস্থিতি তৈরি- সবকিছুই কয়েক মিনিটের মধ্যে, এবং প্রায় বাস্তবসম্মতমানের সাথে সম্ভব হয়ে উঠেছে।
ফলে এমন বহু ভিডিও প্রথম দৃষ্টিতে বাস্তব মনে হলেও পরবর্তী যাচাই প্রমাণ করে যে এগুলো সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে নির্মাণ করা। এ ধরনের প্রযুক্তি শুধু তথ্যবিকৃতি বা বিভ্রান্তি সৃষ্টিই নয়; বরং ব্যক্তির মান-সম্মানহানি, অপবাদ, রাজনৈতিক প্রভাবসৃষ্টি, এমনকি ধর্মীয় বা আদর্শগত বিভ্রান্তি ছড়ানোসহ সবকিছুর ক্ষেত্রেই এক ভয়াবহ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে "ভিডিওতে যা আছে, তাই সত্য" প্রচলিত এই মানসিকতা এক বিপজ্জনক সরলীকরণে পরিণত হয়েছে। জেনারেটিভ এআই-এর যুগে দৃশ্যমান প্রমাণের নির্ভরযোগ্যতা আর স্বতঃসিদ্ধ নয়; বরং প্রযুক্তিগত যাচাই, উৎসনির্ভরতা ও প্রসঙ্গভিত্তিক সমালোচনামূলক মূল্যায়ন এসবই এখন সত্যনির্ণয়ের অপরিহার্য শর্ত।
সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর ইলম: এক নতুন সংকট
দ্বীন ইসলাম এমন একটি জ্ঞানের ক্ষেত্র, যা শুধু আধ্যাত্মিকতার নয়; বরং গভীর তাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, উসুলি ও যুক্তিভিত্তিক পরিশ্রমের সমন্বয়। ইসলামি জ্ঞানজগতের প্রতিটি শাখা: আকীদা, ফিকহ, তাফসির, হাদিস, উসুল দীর্ঘ শতাব্দী জুড়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে মুজতাহিদ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফুকাহাদের কষ্টসাধ্য গবেষণা, পরিমার্জন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়েছে। এই বিশাল ইলমি উত্তরাধিকারকে বোঝা, ধারণ করা ও ব্যাখ্যা করা কোনোভাবেই তাৎক্ষণিক শিক্ষায় সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে একটি প্রাথমিক প্রশ্ন অপরিহার্য হয়ে ওঠে, যে ব্যক্তি দ্বীনের কথা বলছে, সে কি প্রকৃত ইলমের হামেল? তার ইলম অর্জনের উৎস কি স্বীকৃত? যে প্রতিষ্ঠান থেকে সে কথা বলছে, সেটি কি নির্ভরযোগ্য ইসলামি মানদণ্ড পূরণ করে? দুঃখজনকভাবে, ডিজিটাল যুগে এই প্রশ্নগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। ভিডিও বা যেন বহু মানুষের কাছে। ধর্মীয় সত্যের মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। অথচ দ্বীনের মতো সংবেদনশীল ও পবিত্র জ্ঞানকে এভাবে ! সহজলভ্য, সংক্ষিপ্তকরণে ও বিনোদনমুখী উপস্থাপনায় নির্ভর করানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
আকীদা ও ফিকহের মতো সুক্ষ্ম ও জটিল বিষয়সমূহের সঠিক বোধ অর্জনে যুগের পর যুগ নিবিষ্ট অধ্যয়ন, শাস্ত্রজ্ঞদের সান্বিধ্য, আরবি ভাষাজ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং উসুলগত দক্ষতা প্রয়োজন। কেউ নিজের স্বল্পজ্ঞান বা ভ্রান্ত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কিছু ভিডিও দেখে ফতোয়া প্রদান করতে বসে গেলে তা সন্দেহাতীতভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও উদ্বাহ-তিন পর্যায়েই বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। আমরা চাইলে হাজারো ব্যক্তিকে পাশ কাটিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে মুখ ফিরাতে পারি, কিন্তু দ্বীনের প্রামাণ্য ব্যাখ্যা এবং ধর্মীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্ব সোশ্যাল মিডিয়ার হাতে সঁপে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম জ্ঞান প্রচারের ক্ষেত্র হতে পারে, কিন্তু জ্ঞান যাচাইয়ের মানদণ্ড হতে পারে না, বিশেষত দ্বীনের ক্ষেত্রে। এখানে সতর্কতা, উৎস-নির্ভরতা, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এবং ইলমি বিশ্বস্ততা- এসবগুলোই অপরিহার্য। দ্বীনকে সহজবোধ্য করা যায়; কিন্তু সহজলভ্যতার নামে তার পবিত্রতা ও নির্ভুলতা ঝুঁকির মুখে ফেলা যায় না।
আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যেখানে তথ্য আমাদের চারদিক থেকে হুরমুর করে আসে। চোখের সামনে, কানে, হাতে প্রতিনিয়ত অগণিত সংবাদ, মতামত ও দাবি ভেসে আসে। কিন্তু ইসলাম আমাদের যে শিক্ষা দেয় তা অত্যন্ত স্পষ্ট, "শোনো, কিন্তু যাচাই করে নাও।"
যে-কোনো কথা সেটি দ্বীনের হোক বা সমাজ-পরিবারের যাচাই-বাছাই ছাড়া গ্রহণ করা একজন সচেতন মুমিনের আচরণ নয়। কারণ, সত্যতা অনুসন্ধান না করলে ভুল তথ্য যেমন মানুষকে বিপথগামী করতে পারে, তেমনি অন্যের অধিকার নষ্ট করা, গুজব ছড়ানো বা মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার মতো বড় গোনাহের দরজাও খুলে যায়।
আজকের এই তথ্য-বন্যার যুগে সঠিককে ভুল থেকে আলাদা করা, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা এবং মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করা, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় আমানত। আর এই আমানত রক্ষা করার মধ্যেই প্রকাশ পায় একজন মুসলিমের চরিত্রের প্রকৃত সৌন্দর্য ও বিশ্বাসের সততা।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা

