Logo

ইসলাম

সাম্য ও মানবতার মূর্ত প্রতীক বিশ্বনবী (সা.)

Icon

সুলতান মাহমুদ সরকার

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৪৮

সাম্য ও মানবতার মূর্ত প্রতীক বিশ্বনবী (সা.)

মানবসভ্যতার দীর্ঘ ও রক্তাক্ত ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আছে, যখন সময় নিজেই থমকে দাঁড়ায়, ইতিহাসের গতিপথ বদলে যায়, আর মানুষের চিন্তা ও মূল্যবোধ নতুন অর্থ পায়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব ঠিক তেমনই এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। তিনি এসেছিলেন এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে মানুষ মানুষকে দমন করত, শক্তি ছিল ন্যায়বিচারের একমাত্র মানদণ্ড, আর মানবিক মূল্যবোধ ছিল বিলুপ্তপ্রায়। সেই অন্ধকার সময়ে তিনি শুধু একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে নয়, বরং মানবতার মুক্তিদূত হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর জীবন ছিল এক জীবন্ত ঘোষণা- মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই সমান, সবাই মর্যাদার দাবিদার।

বিশ্বনবীর মানবতাবাদ কোনো বিমূর্ত দর্শন ছিল না, কোনো উচ্চমার্গীয় বাগ্মিতা ছিল না; বরং তা ছিল তাঁর প্রতিদিনের জীবনের বাস্তব প্রতিফলন। তিনি এমন এক সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন, যেখানে গোত্রই ছিল পরিচয়, বংশই ছিল সম্মানের মাপকাঠি, আর সম্পদই ছিল ক্ষমতার উৎস। অথচ তিনি সেই সমাজেই ঘোষণা করেছিলেন- আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই, যে সবচেয়ে বেশি ন্যায়পরায়ণ ও সংযমী। এই ঘোষণা শুধু ধর্মীয় বক্তব্য ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সামাজিক বিপ্লব, যা মানুষের চিন্তার ভিত্তিকেই বদলে দিয়েছিল। এই বিপ্লব মানুষকে জন্মগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে বের করে এনে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের পথে পরিচালিত করেছিল।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাপিত জীবন ছিল সাম্য ও মানবিকতার এক নিরবচ্ছিন্ন পাঠ। তিনি ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে থেকেও সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করেছেন। তিনি মাটিতে বসে খেতেন, নিজের জুতা নিজে সেলাই করতেন, ঘরের কাজে পরিবারকে সাহায্য করতেন। তাঁর এই জীবনধারা ছিল এক সুস্পষ্ট বার্তা- নেতৃত্ব মানে বিলাসিতা নয়, বরং দায়িত্ব; ক্ষমতা মানে ভোগ নয়, বরং সেবা। সমাজের প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা, দরিদ্র ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো প্রমাণ করে, তাঁর কাছে রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়েও মানুষের হৃদয় জয় করা ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্যের প্রশ্নে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সম্পূর্ণ আপসহীন। তিনি কখনো ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব, কালো-সাদার বিভাজনকে গ্রহণ করেননি। বিদায় হজের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “কোনো আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোনো অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।” এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি মানবজাতিকে একটি অভিন্ন পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। আজকের আধুনিক বিশ্ব যেখানে এখনো বর্ণবাদ ও জাতিগত বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারেনি, সেখানে চৌদ্দশ বছর আগে উচ্চারিত এই বাণী মানবতার এক চিরন্তন ঘোষণাপত্র হয়ে আছে, যা আজও সমানভাবে সকল স্থানে প্রাসঙ্গিক।

দাসপ্রথা ছিল তৎকালীন সমাজের এক নির্মম বাস্তবতা। মানুষ মানুষকে পশুর মতো ক্রয়-বিক্রয় করত, দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ব্যবস্থাকে এক ঝটকায় বিলুপ্ত না করলেও, এমন এক মানবিক কাঠামো তৈরি করেছিলেন, যার ফলে দাসপ্রথার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। তিনি দাস মুক্ত করাকে পুণ্যের কাজ ঘোষণা করেন, দাসদের প্রতি সদয় আচরণকে ঈমানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন। দাসকে ভাই বলে সম্বোধনের শিক্ষা দিয়ে তিনি সামাজিক সম্পর্কের ভাষাই বদলে দেন। বিলাল (রা.)-এর মতো একজন প্রাক্তন দাসকে ইসলামের ইতিহাসে সম্মানের উচ্চাসনে বসানো ছিল তাঁর সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা গোটা মানবজাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানবতার ইতিহাসে এক বিপ্লবী সংস্কারক। যে সমাজে নারীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো, যেখানে নারীর মতামতের কোনো মূল্য ছিল না, সেখানে তিনি নারীর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করেছেন, বিবাহে সম্মতির অধিকার দিয়েছেন, তালাক ও খোরপোশের ন্যায়সংগত বিধান প্রবর্তন করেছেন। তিনি কন্যাসন্তানকে অবহেলার বস্তু নয়, বরং রহমত হিসেবে দেখার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও সম্মান নারীর মর্যাদা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এক অনন্য উদাহরণ, যা পরিবার ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই নারীর সম্মান নিশ্চিত করার দিকনির্দেশনা দেয়।

ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কঠোর ও নিরপেক্ষ। তিনি কখনো আত্মীয়তা, গোত্র কিংবা ক্ষমতার প্রভাবকে ন্যায়বিচারের পথে বাধা হতে দেননি। তাঁর বিচারব্যবস্থায় সবাই ছিল সমান, ধনী-দরিদ্র, মুসলিম-অমুসলিম, ক্ষমতাবান-নিরীহ। এই ন্যায়বিচার কেবল শাস্তিমুখী ছিল না; বরং তা সমাজে নৈতিক ভারসাম্য ও পারস্পরিক আস্থার ভিত গড়ে তুলেছিল। ফলে দুর্বল মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি ভরসা খুঁজে পেয়েছিল।

মানুষের মৌলিক অধিকার বিষয়ে বিশ্বনবীর অবদান মানবসভ্যতার ইতিহাসে অনন্য। তিনি মানুষের জীবন, সম্পদ, সম্মান ও বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে অলঙ্ঘনীয় ঘোষণা করেছিলেন। বিদায় হজের ভাষণে তাঁর দেওয়া দিকনির্দেশনা আজও আধুনিক মানবাধিকার ধারণার সঙ্গে বিস্ময়করভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অথচ পার্থক্য হলো- ইসলামে এই অধিকারগুলো কেবল রাষ্ট্রীয় আইন নয়, বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত, যা মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত করে তোলে।

হাদিস ও ছোট ছোট ঘটনাবলিতে তাঁর মানবিকতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি ক্ষুধার্তকে খাদ্য দিয়েছেন, এতিমের মাথায় হাত বুলিয়েছেন, বিধবার দায় নিজের কাঁধে নিয়েছেন, এমনকি পশু-পাখির প্রতিও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের দিন, যখন তিনি চাইলে প্রতিশোধ নিতে পারতেন, তখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন- “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেই।” এই ক্ষমাশীলতা ছিল প্রতিহিংসাপরায়ণ মানবসমাজের জন্য এক অনন্য নৈতিক শিক্ষা।

প্রচলিত আধুনিক অধিকার ধারণা অনেক সময় শক্তির রাজনীতির কাছে পরাজিত হয়। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অধিকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা মানুষের বিবেকের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই বিবেকই মানুষকে অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেতন করে তোলে। তাঁর দেখানো পথে অধিকার মানে কেবল দাবি নয়, বরং দায়িত্বও আর এই দায়িত্ববোধই একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল শক্তি।

আজকের বিভক্ত ও সংকটময় বিশ্বে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাম্য ও মানবতাবাদী আদর্শ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধ, বৈষম্য, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মানবিক অবক্ষয়ের এই সময়ে তাঁর জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে মতভেদ সত্ত্বেও সহাবস্থান সম্ভব, কীভাবে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিনয় বজায় রাখা যায়, আর কীভাবে ন্যায় ও দয়া একসঙ্গে চলতে পারে। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষকে ভালোবাসা মানেই আল্লাহকে ভালোবাসা, আর মানুষের অধিকার রক্ষা মানেই সত্যিকারের ধার্মিকতা।

সুতরাং বিশ্বমানবতার কাণ্ডারি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সাম্য ও মানবতাবাদের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁর জীবন ছিল এক চলমান মানবিক সংবিধান, তাঁর বাণী ছিল মানুষের মুক্তির দিশারি। সময়ের স্রোতে সভ্যতা বদলালেও তাঁর আদর্শ আজও অ¤øান। যতদিন পৃথিবীতে অবিচার থাকবে, বৈষম্য থাকবে, ততদিন তাঁর দেখানো পথ মানবতার জন্য আশার আলো হয়ে জ্বলতে থাকবে- মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অনন্ত প্রেরণা হয়ে।

লেখক : কলামিস্ট, এমফিল গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর