Logo

ইসলাম

থার্টি ফার্স্ট নাইট

মুসলিম সমাজে আত্মঘাতী অপসংস্কৃতি

Icon

মুফতি উবায়দুল হক খান

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৩২

মুসলিম সমাজে আত্মঘাতী অপসংস্কৃতি

‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ এই শব্দগুচ্ছের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ইউরোপীয় সভ্যতার নোংরামি, নাপাকি ও আত্মবিস্মৃত উন্মাদনা। এটি কোনো নিরীহ উৎসব নয়; বরং এটি এমন এক বিজাতীয় সংস্কৃতি, যার সঙ্গে ঈমান, তাকওয়া ও মুসলিম জীবনাচারের কোনো সামঞ্জস্য নেই। যে হৃদয়ে ঈমানের আলো জ্বলে, সে হৃদয় কখনো এই অপসংস্কৃতিকে আপন করে নিতে পারে না। 

অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- আজ মুসলিম সমাজের একটি বড় অংশ না জেনেই, না ভেবেই এই সংস্কৃতির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, খ্রিস্টবর্ষের সর্বশেষ রাতকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বহু দেশে যে উন্মত্ত উদযাপন চলে, তার মূল লক্ষ্য আত্মসংযম নয়; বরং লাগামহীন ভোগ, নাচ-গান, মদ্যপান ও নৈতিক সীমা লঙ্ঘন। এক রাতেই অসংখ্য যুবক-যুবতী গুনাহের স্রোতে আকণ্ঠ ডুবে যায়, নিজের দীন ও চরিত্রকে বিসর্জন দেয়। 

নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর নামে সারা রাত ধরে চলে গান-বাজনা, অশ্লীল নৃত্য, আতশবাজি ও শব্দদূষণ। আকাশজুড়ে রঙিন আলো, বিকট শব্দ আর উল্লাসধ্বনি। যার ভেতরে নেই কোনো আত্মশুদ্ধি, নেই কোনো কল্যাণের বার্তা।

এক সময় এই নোংরা সংস্কৃতি মূলত অমুসলিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে মুসলমানরাই যেন এতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। নিজেদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইসলামি সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে পশ্চিমা অপসংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ার এই মানসিকতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলার প্রবাদে আছে ‘পরের হাতের মিঠা খেতে বড়ই মিঠা।’ আজ যেন সেই প্রবাদ মুসলিম সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের ঐতিহাসিক পটভূমি :

অনেক মুসলিম ভাই-বোন জানেন না- এই থার্টি ফার্স্ট নাইটের উৎপত্তি কোথায়, কেন এর প্রচলন। না জেনেই তারা বছরের পর বছর এটি উদযাপন করে যাচ্ছে। 

অথচ প্রশ্ন হওয়া উচিত- এটি অন্য দিনের তুলনায় আলাদা কী? কেন এটিকে উদযাপন করতেই হবে?

ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের প্রায় ৪৬ বছর আগে রোমান মুশরিকরা ‘জানুস’ ঔধহঁং নামক এক দেবতার পূজা করত। তারা তাকে ‘শুরুর দেবতা’ বা এড়ফ ড়ভ ইবমরহহরহমং মনে করত। রোমানরা বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিল, আর ঔধহঁং ছিল তাদের অন্যতম। তাদের বিশ্বাস ছিল-ঔধহঁং অতীত ও ভবিষ্যৎ সবই জানে এবং মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এই দেবতার নাম অনুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয় ঔধহঁধৎু। 

নতুন বছর শুরু হলে তারা ঔধহঁং-কে খুশি করার জন্য উৎসব করত, যেন সে বছরটিকে তাদের জন্য মঙ্গলময় করে তোলে। ঔধহঁং-এর মূর্তিতে দুইটি মুখ দেখা যায়- একটি সামনে, একটি পেছনে। যা প্রতীকীভাবে অতীত ও ভবিষ্যৎ দেখার ধারণা বহন করে।

পরবর্তীতে ঈসা আ.-এর জন্মের বছরকে সূচনাকাল ধরে ১৫৮২ সালে চড়ঢ়ব এৎবমড়ৎু ঢওওও ক্যালেন্ডারের সংস্কার করেন, যা এৎবমড়ৎরধহ ঈধষবহফধৎ নামে পরিচিত। আজ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই দিনপঞ্জি অনুসরণ করে। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকেই নতুন খ্রিস্টবর্ষের গণনা শুরু হয় এবং ঊনিশ শতক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিউ ইয়ার উদযাপন জনপ্রিয়তা পায়।এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকেই স্পষ্ট-থার্টি ফার্স্ট নাইট কোনো মুসলিম সংস্কৃতি নয়। এর শিকড় পৌত্তলিক বিশ্বাস ও পশ্চিমা ভোগবাদী চিন্তায় প্রোথিত।

থার্টি ফার্স্ট নাইটের ভয়াবহ ক্ষতি :

প্রথমত, এই উদযাপন সমাজে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে উসকে দেয়। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অশালীন পোশাক ও আচরণ বহু তরুণ-তরুণীর লজ্জাবোধ ধ্বংস করে দেয়। অথচ ইসলামে লজ্জা ও সতীত্ব একজন নারীর অন্যতম বড় সম্পদ।

দ্বিতীয়ত, এই রাতে হই-হুল্লোড়, পটকাবাজি ও উচ্চ শব্দে রাতের নীরবতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়। শিশুদের ঘুম ভেঙে যায়, অসুস্থ মানুষ কষ্ট পায়, পরীক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। তাহাজ্জুদগুজার বান্দার ইবাদতেও বাধা সৃষ্টি হয়। শারঈ নিষেধাজ্ঞার বাইরে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি চরম অমানবিক আচরণ।

তৃতীয়ত, এটি ভয়াবহ অর্থ অপচয়ের একটি উপলক্ষ। আতশবাজি, রঙ, হোটেল বুকিং, পার্টি, নাচ-গান-এসবের পেছনে অপ্রয়োজনীয়ভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। ধনীদের জন্য এটি হয়তো সহজ, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত তরুণদের জন্য এই ব্যয় অনেক সময় ভবিষ্যৎ ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

চতুর্থত, এই রাতকে কেন্দ্র করে হোটেল, রিসোর্ট, নাইট কদ্বাব ও পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কেউ যদি বলে, ‘আমরা খারাপ কিছু করব না,’ তবে হয় সে অন্যকে ধোঁকা দিচ্ছে, নয়তো নিজেই আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছে।

ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি ও আমাদের করণীয় :

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সঙ্গে সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ এই হাদিস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে-বিজাতীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ একজন মুসলমানের জন্য ঈমানি বিপদের কারণ।

অতএব, প্রিয় অভিভাবকদের প্রতি বিশেষ আহ্বান- আপনার সন্তানদের ব্যাপারে সচেতন হোন। 

তাদেরকে ইসলামি শিক্ষা, শালীনতা ও আত্মমর্যাদাবোধে গড়ে তুলুন। অপসংস্কৃতির কালো থাবা থেকে তাদের রক্ষা করুন। অন্যথায় এই সন্তানই একদিন আপনার দুনিয়া ও আখিরাতের পরীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

শেষ কথা হলো-নিজেদের সংযত হতে হবে, সন্তানদের সঙ্গে সময় দিতে হবে, তাদের চিন্তা ও চেতনাকে বিশুদ্ধ পথে পরিচালিত করতে হবে। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের ও আমাদের সন্তানদের সকল ফিতনা-ফাসাদ থেকে হেফাজত করেন এবং প্রকৃত মুসলিম হিসেবে জীবন যাপনের তাওফিক দান করেন। আমিন।

লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর