রাজসাক্ষী : আসামি থেকে রাষ্ট্রের সাক্ষী হয়ে ওঠার আইনি প্রক্রিয়া

ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ২১:২৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের আত্মপ্রকাশের পর ‘রাজসাক্ষী’র আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে জনপরিসরে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কে এই রাজসাক্ষী? কীভাবে একজন আসামি রাষ্ট্রের সাক্ষী হয়ে উঠতে পারেন? কী সুযোগ, শর্ত এবং ঝুঁকি নিয়ে তৈরি হয় এই আইনি ভূমিকা? এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হলো এই আইনি কাঠামো ও এর রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব।
রাজসাক্ষী কে?
আইনি পরিভাষায় রাজসাক্ষীকে বলা হয় Approver—একজন এমন ব্যক্তি যিনি কোনো অপরাধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থেকেও নিজের দোষ স্বীকার করেন এবং সহ-অপরাধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষে আদালতে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হন। মূলত রাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে তিনি আসামি থেকে সাক্ষী হয়ে ওঠেন।
আইনি কাঠামো : কোন ধারায় রাজসাক্ষী?
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৩৩৯ ধারা অনুযায়ী— কেউ যদি নিজের দোষ স্বীকার করে অপরাধের পূর্ণ বিবরণ ও সহ-অপরাধীদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ দিতে রাজি হন, তবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দির ভিত্তিতে তাকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা করা যেতে পারে। এই ক্ষমাপ্রাপ্ত সাক্ষীকেই বলা হয় রাজসাক্ষী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১৫ নম্বর ধারাতেও অনুরূপ বিধান রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—এই ক্ষমা স্বয়ংক্রিয় নয়; বরং এটি বিচারকের সন্তুষ্টি ও রাষ্ট্রের স্বার্থ বিবেচনায় নির্ভরশীল।
ইতিহাস ও প্রয়োগ : ভারতীয় উপমহাদেশের নজির
রাজসাক্ষীর ধারণা উপমহাদেশে নতুন নয়। বহু বড় অপরাধের বিচারে রাজসাক্ষীর জবানবন্দি মামলা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এটি প্রচলিত, বিশেষত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বা সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে।
শর্ত ও সীমাবদ্ধতা : সব সাক্ষী রাজসাক্ষী নন
একজন রাজসাক্ষীর বক্তব্য গ্রহণের আগে আদালতকে নিশ্চিত হতে হয়—
- তিনি পূর্ণ, সৎ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়েছেন কি না,
- কোনো তথ্য গোপন করেননি বা মিথ্যা বলেননি,
- তার জবানবন্দি অন্যান্য প্রমাণ ও সাক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যদি আদালত মনে করেন, সাক্ষ্য অসম্পূর্ণ বা অসত্য, তবে তাকে পুনরায় আসামি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
সুবিধা ও ঝুঁকি : সুযোগের সঙ্গে রয়েছে হুমকিও
সুবিধা
- মামলার দায় থেকে অব্যাহতি বা শাস্তি হ্রাসের সুযোগ।
- কারাগারে আলাদা নিরাপত্তা ও সেল সুবিধা।
- প্রশাসনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিধান।
ঝুঁকি
- সহ-অপরাধীদের রোষানলে পড়া।
- দীর্ঘ বন্দিদশা।
- সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়া।
- পরবর্তীতে রাজনৈতিক বা সামাজিক চাপের সম্মুখীন হওয়া।
মামুনের স্বীকারোক্তি : একটি নজিরবিহীন ঘটনা
২০২৫ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান ঘিরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেশের সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন নিজ দোষ স্বীকার করে ট্রাইব্যুনালের কাছে বলেন—
‘আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। আমি দোষী। আমি বিস্তারিত তুলে ধরতে চাই।’
আদালত তার বক্তব্য গ্রহণ করেন এবং তাকে রাজসাক্ষী হিসেবে বিবেচনার নির্দেশ দেন।
এই মামলায় এখনো বিচার চলছে, এবং মামুনের পাশাপাশি মামলার প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধেও অভিযোগ গঠন হয়েছে।
রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ও বিতর্ক
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজসাক্ষীর এই ভূমিকা একদিকে যেমন অপরাধের গভীরে পৌঁছানোর পথ খুলে দেয়, অন্যদিকে এটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য একটি সংবেদনশীল হাতিয়ার। তাই এর ‘ব্যবহার হতে হবে অত্যন্ত সতর্কভাবে ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে’। নইলে এর ওপর আস্থা হারাতে পারে সমাজ।
তারা আরও বলেন, শুধুমাত্র রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দণ্ড প্রদান সম্ভব হলেও, তা হতে হবে বিচারকের পূর্ণ আস্থার ভিত্তিতে এবং অন্যান্য প্রমাণের সহায়তায়।
বিচারিক স্বার্থ বনাম ন্যায়বিচার
বিশ্লেষকদের মতে, রাজসাক্ষী পদ্ধতি একদিকে যেমন রাষ্ট্রকে অপরাধ নির্মূলে সহায়তা করে, তেমনি এর অপব্যবহারের ঝুঁকিও নেহাত কম নয়। কেউ কেউ এটিকে দোষ এড়ানোর একটি কৌশল বলেও উল্লেখ করছেন। তবে যদি রাষ্ট্র সত্যিই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চায়, তবে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য রাজসাক্ষীর জবানবন্দি একটি অমূল্য হাতিয়ার হতে পারে—যতক্ষণ তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও চাপমুক্তভাবে নেওয়া হয়।
রাজসাক্ষীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটি অপরাধ তদন্ত ও বিচারে বহু সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান মামলাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের স্বীকারোক্তি মামলার গতিপথ কতটা পাল্টাবে, কিংবা তিনি আদৌ চূড়ান্তভাবে দায়মুক্তি পাবেন কি না—তা নির্ধারিত হবে আদালতের রায়ে। তবে এটুকু বলা যায়, এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাজসাক্ষী ব্যবস্থাটি আবারও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে—যা ভবিষ্যতের বিচারিক সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এফএটি/এমএইচএস