চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিকারে বিএমডিসিতে অভিযোগের স্তূপ

আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫২

বিএমডিসির নিয়ম অনুযায়ী, চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যু বা বড় ধরনের ক্ষতির অভিযোগের সত্যতা মিললে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী স্থায়ীভাবে নিবন্ধন হারাতে পারেন চিকিৎসক। তবে দেশের ইতিহাসে চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসকের আজীবনের জন্য নিবন্ধন বাতিলের নজির নেই।
জানা যায়, চিকিৎসায় অবহেলাজনিত ঘটনার প্রতিকার পেতে গত দেড় বছরে রেকর্ডসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি)। এ সময়ে ৬০টির বেশি আবেদন করেছেন ভুক্তভোগীরা। জুলাই বিপ্লবের পর গতি বাড়ায় মিলছে প্রতিকারও। গত ১০ মাসেই ডজনের বেশি চিকিৎসকের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। বিএমডিসির ইতিহাসে এক বছরের মধ্যে শাস্তির হারে এটাই সর্বোচ্চ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধ সব সময়ই হয়েছে, কিন্তু প্রতিকার পাওয়ার জায়গা জানতে না পারায় অভিযোগের হার কম ছিল। বর্তমানে মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ বেড়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে অভিযোগুলো দিনের পর দিন ঝুলে থাকত, নিষ্পত্তির ঘটনা ছিল খুবই কম। এ ছাড়া অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও গোপন সমঝোতায় অনেক অপরাধীই বেঁচে যেতেন। তবে বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে বিএমডিসি পুনর্গঠিত হলে গতি বেড়ে যায়। এরপর থেকে একের পর এক বিচার নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিএমডিসির তথ্যমতে, চিকিৎসায় অবহেলাজনিত অভিযোগে বিগত বছরগুলোতে ২০ থেকে ৩০টি অভিযোগ জমা পড়ত। কিন্তু ২০২৪ সালে এই সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৪৫ বছরে প্র্যাথমিকভাবে ৪৪৫টি অভিযোগের তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে। এর মধ্যে আমলযোগ্য অভিযোগ ছিল ১৭২টি। এসব অভিযোগের ৬১টি এসেছে ২০২৪ সালে। এ ছাড়া আগের বছর ২০২৩ সালে ছিল ১৮টি ও ২০২২ সালে ২৮টি। আর চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ২৩টি অভিযোগ এসেছে।
চিকিৎসায় অবহেলার প্রথম শাস্তি হয় ১৯৯৩ সালে। পিত্তথলির অস্ত্রোপচারে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে প্রাণ হারান কুমিল্লা ইয়াংম্যান বুড্ডিস্টের সভাপতি শীল ভদ্র ভিক্ষু। এ ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসক অরুণ জ্যোতি চাকমাকে শুরুতে আজীবনের জন্য নিবন্ধন বাতিল করা হয়। তবে দুই বছরের মাথায় নিবন্ধন ফিরে পান ওই চিকিৎসক। যদিও তিনি আর চিকিৎসা পেশায় ফেরেননি।
বিএমডিসি বলছে, এখন পর্যন্ত মোট অভিযোগের মধ্যে ৯৩টি নিষ্পত্তি হয়েছে, বিচারাধীন ৭৯টি। বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২৯ জন চিকিৎসকের বিভিন্ন মেয়াদে নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ মাসেই নিবন্ধন স্থগিত হয়েছে ১৩ জন চিকিৎসকের, যা এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া আরো আট চিকিৎসক ও ১০ হাসপাতালকে সতর্ক করা হয়েছে।
বিএমডিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের আগে অভিযোগ এলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও বিএমডিসির শৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সদস্যের যোগসাজশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাঝপথেই সমঝোতা করতে বাধ্য হতেন ভুক্তভোগীরা। এমনকি ভয়ভীতিও দেখানো হতো ভুক্তভোগীদের। আর এতে করে তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা লেগে যায়। মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদের মাধ্যমে অন্তত ২০টি অভিযোগ মাঝপথে থেমে গেছে বলে জানান একজন কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৪ অক্টোবর বিএমডিসি পুনর্গঠিত হয়। কাউন্সিলের সভায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ভুক্তভোগীদের কথা মাথায় রেখে নিষ্পত্তির সময় কমাতে সর্বোচ্চ জোর দেন। এরপর থেকে অভিযোগ পেলেই সেটি তথ্য যাচাই-বাছাই করে আমলযোগ্য হলেই দ্রুত কাজ করা হচ্ছে। স¤প্রতি যে ১৩ জনের নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলেছিল। গতি বাড়ায় এখন দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে।
এদিকে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিকার পাওয়ায় অবহেলাজনিত ঘটনার অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিএমডিসির এক কর্মকর্তা। তার মতে, ২০ বছর আগে চিকিৎসায় অবহেলায় মারা গেলে কিংবা অপচিকিৎসার শিকার হলে প্রতিকার পাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। ২০১০ সালে ‘অ্যাক্ট’ পাসের পর কাঠামোগতভাবে কাজ করার সুযোগ পায় বিএমডিসি। এরপর সংখ্যায় কম হলেও ব্যবস্থা নেওয়ায় মানুষ প্রতিকার পেতে আবেদন করতে থাকে।
চিকিৎসায় অবহেলার ঘটনা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, চিকিৎসকরা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করা শুরু করেছেন, তাদের যা ইচ্ছে তা করার অধিকার আছে বলে মনে করেন। তারা জবাবদিহির ভেতরে এলে নিজেদের শোধরানোর চেষ্টা করবে। শাস্তির এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা আরো কমে আসবে। এজন্য বিএমডিসির তৎপরতা আরো জোরদার করতে হবে।
বিকেপি/এমবি