
‘রিমান্ড’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পুনঃপ্রেরণ। রিমান্ড শব্দটি মূলত ফৌজদারী মামলায় আসামির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে রিমান্ড বলতে সাধারণ ভাষায় ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট কোনো আসামিকে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুনরায় ফেরত নেওয়াকে বুঝায়। কখনোই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করাকে বুঝায় না।
ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারায় রিমান্ডের কথা বলা হলেও ওই কার্যবিধির কোথাও রিমান্ড শব্দটির সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তকার্য সমাপ্ত না হলে এবং ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিকটবর্তী আদালতের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড প্রার্থনা করতে পারেন, যা একটি মামলায় বা একসঙ্গে ১৫ দিনের অধিক হবে না।
দেওয়ানী মোকদ্দমার ক্ষেত্রেও রিমান্ড আদেশ হয়। আপীল আদালত বা ডিভিশনাল আদালতও ন্যায়বিচার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বিচারিক আদালতে পুনঃফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়ে থাকেন। দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ৪১ আদেশের যে সকল বিধি রিমান্ডের পক্ষে ও বিপক্ষে আছে তা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই দেয়া হয়েছে। যদিও ৪১ আদেশের ২৭, ২৮, ৩৩ বিধিসমূহের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য বটে, আপিল আদালতের সদিচ্ছায় অনেক রিমান্ড আদেশ নাও হতে পারে।
পুলিশ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও একটি নিরাপদ হেফাজত। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনই পুলিশের নীতি। তবে পুলিশ হেফাজত অপরাধীদের জন্য প্রশ্নবহ। আবার মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে বা কোনো পুলিশী আটকের প্রেক্ষিতে পুলিশের হেফাজত অপরাধীর জন্য ভীতির কারণ হতে পারে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো অপরাধে যুক্ত সন্দেহে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পুলিশেকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি বা এজাহারভুক্ত আসামি গ্রেফতার হলে পুলিশ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় কাউকে আটক রাখতে পারে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কাজ সমাপ্ত করতে না পারলে সেই কারণে তার বিরুদ্ধে অপরাধের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে রিপোর্টসহ নিকটস্থ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থিত করতে হয়। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ এবং ৩৬৪ ধারায় বিধিবিধান পালনপূর্বক নির্ধারিত ফরমে বা ফরম না থাকলে সাদা কাগজে ফরমের আকারে বা ফরমে বর্ণিত চাহিদা মতো আইনানুগভাবে জবানবন্দী রেকর্ড করতে পারেন। আটককৃত ব্যক্তি যদি জবানবন্দী দিতে অস্বীকার করে তবে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারেন। বিশেষ কারণবশত পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে পুনরায় রিমান্ডের আদেশও দিতে পারেন।
প্রতিটি দেশের সংবিধান নাগরিকের রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই স্বাধীন ও মুক্ত। অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক আটক রাখা বেআইনি, তা ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশ সংবিধানের নিমোক্ত অনুচ্ছেদগুলো লক্ষণীয়, সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের ও সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত, আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তির হানি ঘটে। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতিরেকে তাকে তদতিরিক্ত কাল প্রহরায় আটক রাখা যাবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইবুন্যালে দ্রুত ও প্রকাশ্যে বিচার লাভের অধিকারী। (৪) কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। (৫) কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। কাউকে অন্ধকার কুটুরিতে আটক রেখে নির্যাতন করা যাবে না।
রিমান্ড একটি আইনি ব্যবস্থা হলেও এখন তা অত্যন্ত ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যায়, আটক বা গ্রেফতারের সময় অনেকেই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করলেও বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করার সময় হুইলচেয়ারে তাকে আনতে হয়। চোর, ডাকাত এমনকি রাজনৈতিক নেতা ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও রিমান্ডের নামে চলে নির্যাতন। রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে, যা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার এবং ১৬৭ ধারায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করে (রিট পিটিশন নম্বর ৩৮০৬/১৯৯৮)। এ প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ রায় দেন। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ফৌজদারী আইন সংশোধন করতে সরকারকে ১৫ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৫ মে ওই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। উচ্চ আদালতে বহুবার এটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছে, আদালত থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও রিমান্ডের অপব্যবহার বাড়ছে, যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক।
রিমান্ডের অপব্যবহার রোধ করার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন আদালতের মতো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও অধঃস্তন আদালতগুলোর জন্য মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র রিমান্ডে আসামীদের ওপর ১৪ ধরনের নির্যাতনের কথা জানতে পেরেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় উল্টো ঝুলিয়ে বেধড়ক পেটানো, মুখে কাপড় ঠুসে পানি ঢালা বা ওয়াটার থেরাপি, ইলেকট্রিক শক দেয়া, হাত পায়ের আঙ্গুলে সুই ঢুকিয়ে নখ উপড়ে ফেলা। এর আগে মলদ্বারে ডিম বা মরিচ ঢুকিয়ে নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। এ ধরনের নির্যাতনের মাধ্যমে আসামীর থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।
আইনানুযায়ী রিমান্ড মানে হল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামীকে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করবে, কোন মারধোর করা যাবে না। সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে গ্রেফতার ও পুলিশ হেফাজতে আটককৃত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসেবে কিছু অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে নির্দেশনা : গ্রেফতারের সময় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলে আঘাতের কারণ লেখা এবং তাকে চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ হাসপাতাল বা সরকারি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে ডাক্তারের সনদ নেওয়া,গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পছন্দমত আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দেওয়া,গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ নিকটতম ম্যাজিস্টেটের নিকট হাজির করা, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা তথ্য কেন সঠিক তার বর্ণনা দেয়া ।
রিমান্ডের আগে ও পরে আটককৃত ব্যক্তির অধিকার : হাইকোর্টের রায়ে রিমান্ডের আগে ও পরে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কিত নির্দেশনা- তদন্তের প্রয়োজনে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এক পাশে কাঁচের দেওয়াল ও গ্রিল দিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা, যাতে করে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়-স্বজন বা আইনজীবীরা জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যটি দেখতে পারলেও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি শুনতে না পারেন। কাঁচের দেয়াল নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামির আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। রিমান্ড আবেদনে রিমান্ডে নেওয়ার বিস্তারিত কারণ লিপিবদ্ধ করা এবং কেস ডাইরি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করা। রিমান্ড আবেদনে ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হলে কারণ লিপিবদ্ধ করে সর্বোচ্চ তিন দিনের রিমান্ডের নেওয়ার অনুমোদন দেয়া। তবে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড প্রার্থনা করতে পারেন যা সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত হতে পারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে নেওয়ার পূর্বে ডাক্তারি পরীক্ষা করা এবং ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাখিল করা। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন তাহলে গ্রেফতারকৃতকে একই ডাক্তার বা মেডিকেল বোর্ডের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠানো মেডিকেল রিপোর্টে পুলিশ হেফাজতে আটককৃত ব্যক্তিকে নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেলে কোন আবেদন ছাড়াই ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
থানা বা পুলিশ হেফাজত বা জেলখানায় আটক ব্যক্তির মৃত্যুর ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা হেফাজতে নেয়া তদন্তকারী কর্মকর্তা বা জেলখানার জেলারের এই মৃত্যুর খবর নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানানো। পুলিশ হেফাজতে বা জেলে কোন মৃত্যুর ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটকে অতিদ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করা এবং মৃত ব্যক্তির ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করা।
বিকেপি/এমবি