বাবা-মায়ের ভরণপোষণ না দিলে লাখ টাকা জরিমানা
অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড

আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৮

- ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধনিবাস কিংবা আলাদাভাবে রাখতে বাধ্য করা যাবে না
- কেউ না থাকলে দিতে হবে দাদা-দাদি, নানা-নানির ভরণপোষণ
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখনো পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিক দায়িত্ববোধ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়- বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা-মা তাদের সন্তানের অবহেলায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। অথচ, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে বাবা-মার ভরণপোষণ ও সেবা-শুশ্রূষার দায়িত্ব সন্তানদের ওপর আইনগতভাবে আরোপ করা হয়েছে।
পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ ব্যক্তি তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনলে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে তাঁরাও একই অপরাধে অপরাধী হবেন। ফলে তাঁদেরও একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তাঁর বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া সন্তান তাঁর মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন।
আইনের ৩-এর (৭) ধারা অনুযায়ী, কোনো বাবা বা মা কিংবা দুজনই সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তান তাঁদের দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমতো, মাসিক আয় বা বার্ষিক আয় থেকে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ বাবা বা মা অথবা উভয়কে নিয়মিত দেবেন। অথবা মাসিক আয়ের কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের কাজে ব্যয় করবেন।
আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিরও ভরণপোষণ করতে হবে। তবে বাবা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণপোষণ করতে হবে না।
এ আইনের অধীনে অপরাধ হবে আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য। আদালত ইচ্ছা করলে প্রথমেই বিষয়টি আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। আপস-নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার কিংবা ক্ষেত্রমতে, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর কিংবা অন্য যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠাতে পারবে। আদালত থেকে কোনো আপস-মীমাংসার জন্য পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বাবা, মা এবং সন্তান উভয় পক্ষের শুনানি শেষে নিষ্পত্তি করতে পারবেন। কোনো অভিযোগ এভাবে নিষ্পত্তি হলে তা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী পি কে আব্দুর রব বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যদি কোনো সন্তান তার বাবা-মার দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে মা-বাবা আদালতে গিয়ে সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। আইন অনুযায়ী, সন্তান বাধ্য- তাকে তার বাবা-মার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখাশোনা করতে হবে। আদালত এ বিষয়ে নিশ্চিত রিলিফ দেয় এবং কোনো বাবা-মা তাদের সন্তানের কাছ থেকে ন্যায্য অধিকার আদায়ে আদালতের সহায়তা চাইলে, আইন তাদের পক্ষে থাকবে।
যদি কোনো বাবা-মা সামাজিক বা পারিবারিকভাবে সন্তানের অবহেলা মোকাবিলা করতে না পারেন, তাহলে তারা পারিবারিক আদালতে গিয়ে ‘ভরণপোষণ মামলা’ দায়ের করতে পারেন। এই আইনের আওতায় আদালত সন্তানের ওপর নির্দিষ্ট ভরণপোষণ নির্ধারণ করে আদেশ দিতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা জজ আদালতের এপিপি কেএম খায়রুল ইসলাম বলেন, যদিও আইনি পথ রয়েছে, তবু বিষয়টি আদালতে না গিয়ে পারিবারিকভাবে সমাধান হওয়াই শ্রেয়। কারণ, পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করা খুবই যন্ত্রণাদায়ক এবং সামাজিকভাবে লজ্জার বিষয়।
বাবা-মার দেখাশোনা ও ভরণপোষণ শুধু আইনি বাধ্যবাধকতাই নয়, এটি মানবিক ও নৈতিক দায়িত্বও বটে। তবে সব উপায় শেষ হলে, আদালতে যাওয়ার অধিকার বাবা-মার রয়েছে এবং সেখানে তারা ন্যায়বিচার পাবেন-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বিকেপি/এমবি