
করিম নামে এক ব্যক্তির প্রয়োজনে স্বরণ নামে একজন ব্যক্তি করিমকে টাকা ধার দিয়েছেন। টাকা দেওয়ার সময় স্বরণ করিমকে বলেছেন, ভাই তোমাকে যে আমি টাকা দিলাম, তার প্রমাণ তো আমার কাছে থাকল না। আমার তো কিছু প্রমাণ থাকা দরকার। যাকে ধার দিলেন সে বলল, ভাই এই যে আমার চেক। এই চেক তোমাকে ফাঁকা স্বাক্ষর করে দিলাম। এবার যাকে (করিমকে) টাকা ধার দিয়েছিলেন তার চেক তো স্বরণের কাছে আছে। স্বরণ চেকের টাকা তুলে আনতে ব্যাংকে গেলেন। তারপর ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংকের কাউন্টারে চেক দিলেন। ব্যাংক কর্মকর্তা স্বরণকে বলল, অ্যাকাউন্টে টাকা নাই। তখন স্বরণ ব্যাংক কর্মকর্তাকে বললেন, তাহলে লিখিত দেন। ব্যাংক কর্মকর্তা স্বরণকে একটি লিখিত মেমো দিলেন, যাতে লেখা আছে, টাকার পরিমাণ কম। চেকসহ মেমো নিয়ে স্বরণ ফিরে আসলেন। এই চেকসহ মেমো নিয়ে ফেরত আসার ঘটনাকে চেক ডিজঅনার বলে।
চেক ডিজঅনার করার শর্তসমূহ : চেকের উপরে যে তারিখ লেখা আছে, সেই তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে আপনাকে চেক ডিজঅনার করাতে হবে। ব্যাংক হিসাবে পরিমাণমতো টাকা থাকলে আপনি চেক ডিজঅনার করাতে পারবেন না। ব্যাংকিং সময়ের মধ্যে আপনাকে চেক ডিজঅনার করাতে হবে।
চেক ডিজঅনারের মামলা করার কারণ : ব্যাংকের হিসাবে অপর্যাপ্ত তহবিল বা অর্থ থাকলে। তার মানে চেকে যে পরিমাণ অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে তা অপেক্ষা কম অর্থ হিসাবে থাকা। যে ব্যক্তি চেক প্রদান করেছে যদি তার স্বাক্ষর না মেলে। যদি চেকে উল্লেখিত অর্থের অঙ্ক ও কথার গরমিল পাওয়া যায়। চেক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে। যথাযথভাবে চেক পূরণ করা না হলে। চেকে ঘষামাজা করলে। চেকে কাটাকাটি থাকলে পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে তা সত্যায়ন করা না হলে।
মামলা করার পদ্ধতি কী? : প্রথমে আপনাকে ব্যাংকে গিয়ে চেক ডিজঅনার করে নিয়ে আসতে হবে। এরপর চেকের টাকা পরিশোধের জন্য ৩০ দিন সময় দিয়ে উকিল নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ দিতে হবে। উকিল নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে, পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। আরও সহজ করে বলতে গেলে, চেক গ্রহীতা বা ধারক চেক ডিজঅনারের বিষয়টি জানার পর ১৩৮ ধারার বিধান মোতাবেক ৩০ দিন সময় দিয়ে টাকা পরিশোধের জন্য চেকদাতাকে নোটিশ দেবেন। ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতা চেকগ্রহীতাকে চেকে উল্লেখিত টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেকগ্রহীতা এখতিয়ারসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।
মামলা দায়েরের সময় বাদীর জাতীয় পরিচয়পত্র, চেক ডিজঅনারের স্লিপ, লিগ্যাল নোটিশের একটি করে ফটোকপি ফিরিস্তি করে জমা দিতে হবে এবং মামলা দায়েরের সময় মূল কপি আদালতে প্রদর্শন করতে হবে। তাছাড়াও মামলার আরজির সঙ্গে প্রসেস ফি দাখিল করতে হবে।
লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করার পদ্ধতি : চেক ইস্যুকারীর প্রতি উকিল নোটিশ মূলত তিনভাবে প্রদান করা যায়। যথা—ক. চেক ইস্যুকারীর হাতে নোটিশটি সরাসরি পৌঁছে দেওয়া। খ. প্রাপ্তি স্বীকার রসিদসহ (এডি) রেজিস্টার্ড ডাকযোগে বাংলাদেশে তার সঠিক ঠিকানায় নোটিশ প্রেরণ করা। গ. বহুল প্রচারিত কোনো বাংলা জাতীয় দৈনিকে ওই উকিল নোটিশ প্রকাশ করা যায়। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, উকিল নোটিশ কিন্তু কোনো জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়ও প্রকাশ করা যাবে।
চেক ডিজঅনারের মামলা করার সময়সীমা: চেকগ্রহীতা ব্যাংক থেকে চেকটি অপরিশোধিত হয়ে ফেরত এসেছে, তা জানার ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেকদাতা চেকগ্রহীতাকে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, চেকদাতা টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার ১ মাসের মধ্যে চেকগ্রহীতা মামলা দায়ের করতে পারবেন।
নোটিশে দেওয়া ৩০ দিন শেষ হওয়ার আগে চেক ডিজঅনারের মামলা করা যাবে কিনা?: নোটিশে দেওয়া ৩০ দিন সময় শেষ হওয়ার আগেও চেক ডিজঅনারের মামলা করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তা না করাই ভালো। আইন মোতাবেক মামলা করাই উত্তম।
চেক ডিজঅনারের নতুন আইন : আমরা জানি পূর্বে শুধুমাত্র চেক ডিজঅনার হলেই চেকদাতাকে সাজা দেওয়া হতো কিন্তু এখন এ আইনের পরিবর্তন করা হয়েছে। চেকগ্রহীতার টাকা পাওয়ার কোনো কারণ আছে কিনা, সেটি দেখা হতো না। এখন চেকগ্রহীতাকে প্রমাণ করতে হবে চেকদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে লেনদেন সম্পর্কিত কোনো বৈধ চুক্তি ছিল এবং মনে রাখতে হবে চেক প্রাপ্তির বৈধ কোনো প্রমাণ দিতে না পারলে চেকদাতার আর কোনো সাজা হবে না।
চেক ডিজঅনারের মামলা কোথায় দায়ের করতে হবে? : চেক ডিজঅনারের মামলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করতে হয়। মেট্রোপলিটন এলাকায় চেক ডিজঅনারের মামলা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা হয়। আর অন্য এলাকায় এই মামলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা হয়। তারপর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অথবা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি প্রস্তুত করে বিচারের জন্য দায়রা আদালতে পাঠিয়ে দেবেন। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার অধীনে চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের করা হয়।
চেক ডিজঅনারের মামলার বিচার সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের নতুন রায় : ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৪১ (গ) ধারা অনুযায়ী, চেক ডিজঅনারের মামলার বিচার করতে পারে দায়রা আদালত। অর্থাৎ Sessions Judge, Additional Sessions Judge, Joint Sessions Judge উনারা সবাই এরূপ মামলার বিচার করতে পারেন এবং এতদিন পর্যন্ত করে আসছেন। তবে সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে— এখন থেকে চেক ডিজঅনারের মামলার বিচার করতে পারবে শুধুমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ (Joint Sessions Judge)।
উচ্চ আদালতের এ রায় সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো : চেক ডিজঅনার মামলা শুধুমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে শুনানি হবে এবং যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতেই আপিল করতে হবে। আগে চেক ডিজঅনারের মামলা দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম দায়রা জজ আদালত শুনানি করতেন। এক্ষেত্রে দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ বিচার করলে বিচারপ্রার্থীকে চেকের মামলায় আপিল করতে আসতে হতো হাইকোর্ট বিভাগে। এই বিধানটি বৈষম্যমূলক, যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ এবং ৩১ এর সাথে সাংঘর্ষিক। রায়ের নির্দেশনা মতে ১৩৮ ধারার চেকের মামলার বিচার কেবলমাত্র যুগ্ম দায়রা জজ আদালত করতে পারবে। দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ চেকের মামলার বিচার করতে পারবে না।
গুরুত্বপূর্ণ কেস রেফারেন্স : [Md. Abulkaher Shahin Vs Emran Rashid and others, 25 BLC (AD) 115] এতদিন চেক ডিজঅনার হলেই চেকদাতাকে সাজা দেওয়া হতো। সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের ফলে এখন থেকে চেকের বৈধ বিনিময় প্রমাণে ব্যর্থ হলে কোনো চেকদাতাকে সাজা দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে চেকপ্রাপ্তির বৈধ কারণ থাকতে হবে। যদি প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের ভিত্তিতে চেক প্রদান করা হয় এবং সেই প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার যদি বাস্তবায়িত না হয় তাহলে চেক প্রদানকারীর টাকা পরিশোধে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না এবং চেকগ্রহীতার কোনো অধিকার তৈরি হবে না।
চেক ডিজঅনারে দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারায় মামলা করা যায় কিনা? : ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারার শুরুতে ‘cognizable offence’ শব্দগুলোর অনুপস্থিতি প্রমাণ করে উক্ত ধারায় কোনো ‘cognizable offence’ নেই। তাই ১৩৮ ধারার অপরাধের কারণে বাদী শুধুমাত্র হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের অধীনেই মামলা করতে পারবে— এই কথাটা ঠিক নয়। দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারার অধীনে আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও বাদীর কোনো বাধা নেই।
নুরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য [৪৯ DLR (HCD) ৪৬৪] মামলায় উপরোক্ত বিষয়ে আলোচনা করে হাইকোর্ট বিভাগ মতামত দেন যে, বাদীপক্ষ ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে।
চেক ডিজঅনার হলে বাদীপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারায় মামলা করতে পারবে অথবা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারাতেও মামলা করতে পারবে।
আসামির মৃত্যু হলে টাকা আদায়ের পদ্ধতি : চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের করার আগেই চেকদাতা মৃত্যুবরণ করলে চেকগ্রহীতার আর কোনো প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকে না। এমনকি আসামি মামলা চলমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও তার উত্তরাধিকারী বা আইনগত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ মামলা চালাতে পারে না। মামলা দায়েরের আগে বা পরে যখনই আসামি মারা যাক না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই বাদীর প্রতিকার হলো মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী বা আইনগত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে টাকার মামলা দায়ের করে উক্ত টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করা।
চেক ডিজঅনার হলে শাস্তি বা জরিমানা : এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা যা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুণ, অথবা উভয়। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮(১) ধারায় চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা আছে, চেক ডিজঅনারের শাস্তি হলো ১ বছরের কারাদণ্ড অথবা চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুণ জরিমানা অথবা উভয়। এখন কথা হলো চেক ডিজঅনারের শাস্তি যদি চেকে উল্লেখিত টাকার ৩ গুণ জরিমানা হয়, তাহলে টাকাটা কে পাবে? এক্ষেত্রে চেকগ্রহীতাকে তার দাবীকৃত টাকাটা পরিশোধ করে বাকী টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে যাবে।
হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ এর ১৩৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, উপধারা (১) মোতাবেক যেক্ষেত্রে অর্থদণ্ড আদায় হয় সেক্ষেত্রে আদায়কৃত অর্থদণ্ড হতে চেকে বর্ণিত টাকা যতদূর পর্যন্ত আদায়কৃত অর্থদণ্ড হতে প্রদান করা সম্ভব চেকের ধারককে প্রদান করতে হবে। সুতরাং চেকের ধারক বা গ্রহীতা চেকে বর্ণিত টাকার বেশি পরিমাণ অর্থ পাওয়ার অধিকারী নয়। কোনো আদালত চেকে বর্ণিত টাকার তিনগুণ পর্যন্ত জরিমানা করলেও বাদীকে চেকে বর্ণিত টাকা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বাকী টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেবেন।
চেক মামলা থেকে বাঁচার উপায়? : ১৩৮ ধারায় চেক ডিজঅনার মামলায় প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। ১৩৮ ধারায় প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে কোথায় আপিল করা যাবে সে সম্পর্কে ১৩৮ থেকে ১৪১ ধারায় কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির আপিলের বিধান প্রযোজ্য হবে। ১৩৮ ধারায় প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে দায়রা জজের নিকট।
তবে চেক ডিজঅনারের মামলায় চেকে উল্লেখিত অর্থের সর্বনিম্ন ৫০% জমা দিয়ে আপিল দায়ের করতে হবে। চেক ডিজঅনারকৃত চেকের টাকার ৫০% টাকা যে আদালত শাস্তি দিয়েছে সেই আদালতে জমা দিয়ে আপিল দায়ের করতে হবে। তার মানে ৫০% টাকাটা বিচারিক আদালতে জমা দিতে হবে, আপিল আদালতে নয়।
বিকেপি