Logo

আইন ও বিচার

আইন মন্ত্রণালয়ের যেসব ক্ষমতা চলে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের হাতে

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৬

আইন মন্ত্রণালয়ের যেসব ক্ষমতা চলে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের হাতে

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়াকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক প্রায় সব প্রশাসনিক ক্ষমতা আইন মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে চলে যাবে।

এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই বাংলাদেশের বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পথে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এটি কার্যকর হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন ও শৃঙ্খলাবিষয়ক সব ক্ষমতা আর আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকবে না- এই সমস্ত দায়িত্ব যাবে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে।”

দীর্ঘদিন ধরে আইন মন্ত্রণালয় অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে আসছে। এতে বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় নির্বাহী প্রভাবের অভিযোগ বহুবার উঠেছে। বিচারক সমাজের অনেকেই মনে করেন, এই কাঠামোতে প্রকৃত বিচারিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নতুন অধ্যাদেশ কার্যকর হলে বিচার বিভাগের প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ আলাদা হবে। সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব সচিবালয়ের মাধ্যমে অধস্তন আদালতের সব প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

অধ্যাদেশ কার্যকর হলে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব বাজেট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা থাকবে। তাদের আর্থিক স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হবে। অর্থাৎ, বিচার বিভাগ প্রশাসন বা আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকবে না। এটি হবে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রশাসনিক কাঠামো- যেখানে বিচার বিভাগ নিজে নিজের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, পদায়ন এবং পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নেবে। এটি শুধু প্রতিষ্ঠানগত স্বচ্ছতাই আনবে না, বরং বিচারকদের মর্যাদা ও স্বাধীনতাও বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে। তবে অধ্যাদেশটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার দাবি নতুন নয়। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সরকার মাসদার হোসেন বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি পায়। 

ওই রায়ে বলা হয়, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করতে হবে এবং বিচারকদের বদলি ও নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকা উচিত। কিন্তু প্রায় দুই যুগ পার হয়ে গেলেও সেই রায় পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বিচার বিভাগের অনেক কর্মকর্তা এবং আইন বিশেষজ্ঞ বহুদিন ধরে দাবি করে আসছেন, “আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিচারকদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে থাকে, বাস্তবে নয়। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপে সেই দীর্ঘস্থায়ী দাবি বাস্তবায়নের পথে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে।

জানা যায়, অধ্যাদেশ কার্যকর হলে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে কাজ করবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন রেজিস্ট্রার জেনারেল। এই সচিবালয়ের অধীনে থাকবেন বিভিন্ন শাখা যেমন- মানবসম্পদ, বাজেট, প্রশিক্ষণ, ও আইনি প্রশাসন। এরা অধস্তন আদালতের সব কার্যক্রম তদারকি করবে, বিচারকদের বদলি ও পদায়নের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করবে এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ তদন্ত করবে।

একজন সাবেক বিচারপতি বলেন, এই পরিবর্তন কার্যকর হলে বিচার বিভাগ আর নির্বাহী বিভাগের ছত্রছায়ায় থাকবে না। এটি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে আরও শক্তিশালী করবে।” আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে আইনশাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয় থেকে যে ক্ষমতাগুলো সুপ্রিম কোর্টে স্থানান্তরিত হবে, তা হলো- অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়ন, বিচারকদের পদোন্নতি ও নিয়োগের প্রক্রিয়া, শৃঙ্খলাবিষয়ক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা, বাজেট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বাধীনতা। সব মিলিয়ে এটি শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা।

যদি এই অধ্যাদেশ দ্রুত অনুমোদন পায় ও বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বিচার বিভাগ আর নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। বরং সত্যিকার অর্থে স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

সুপ্রিম কোর্ট

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর