Logo

আইন ও বিচার

পাগল বা মানসিক রোগীর সম্পত্তির তত্ত্বাবধান

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৩৬

পাগল বা মানসিক রোগীর সম্পত্তির তত্ত্বাবধান

বাংলাদেশে যদি কোনো ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন বা আইনের ভাষায় “অপ্রকৃতস্থ (lunatic/mentally unsound)” ঘোষিত হন, তবে তাঁর সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব কেবল পরিবারের নয়- এ বিষয়ে আদালতের সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। দেশের মানসিক রোগীর সম্পত্তি তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত আইন মূলত Lunacy Act, 1912 (বর্তমানে আংশিকভাবে কার্যকর), Guardians and Wards Act, 1890, Ges Code of Civil Procedure (CPC) তে নির্দিষ্ট ধারায় নির্ধারিত হয়েছে।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, এমন কোনো ব্যক্তি, যিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন এবং নিজের কাজকর্ম বা সম্পত্তি সংরক্ষণ বা ব্যবহার সঠিকভাবে পরিচালনা করতে অক্ষমতাকে বলা হয় ‘অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি’ আদালত বা চিকিৎসা কর্তৃপক্ষের রিপোর্টের ভিত্তিতে কারও মানসিক অবস্থা নির্ধারণ করা হয়।

মানসিক রোগীর সম্পত্তি ও স্বার্থ রক্ষার জন্য আদালত একজন Guardian/Manager নিয়োগ করতে পারেন। এ প্রক্রিয়াটি মূলত Lunacy Act, 1912-এর ধারা ৬৭ থেকে ৭৭ পর্যন্ত বর্ণিত, এবং Guardians and Wards Act, 1890-এর ১৭ ধারা অনুযায়ী আদালতের ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত। মানসিক রোগীর সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে অভিভাবক নিয়োগের জন্য আবেদন করতে হয় জেলা জজ আদালতে। রোগীর স্থায়ী ঠিকানার এলাকার আদালতে অথবা যেখানে তাঁর স্থাবর সম্পত্তি অবস্থিত সেই জেলার আদালতে।

আবেদন করতে পারেন রোগীর নিকট আত্মীয় (স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন বা অভিভাবক)। আর যদি আত্মীয় না থাকলে, কোনো নিকট আত্মীয় বা সরকারি সংস্থা আদালতের অনুমতিক্রমে আবেদন করতে পারে। কোনো নাগরিক বা সংগঠনও আদালতে আবেদন করতে পারে যদি মানসিক রোগী নিজে অক্ষম হন।

আদালতের প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে আদালত প্রথমে চিকিৎসকের রিপোর্ট চান- রোগীর মানসিক অবস্থা সত্যিই অপ্রকৃতিস্থ কিনা তা নির্ধারণের জন্য। এরপর রোগীর নিকটাত্মীয়দের নোটিশ পাঠানো হয় এবং প্রয়োজনে আদালত রোগীকে সরাসরি দেখতে বা মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে পারেন।

যদি আদালত নিশ্চিত হন যে, রোগী সম্পত্তি পরিচালনা করতে অক্ষম, তবে আদালত একজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তা (যেমন- District Collector /Administrator General) কে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ করেন।

তত্ত্বাবধায়কের ক্ষমতা ও দায়িত্ব : আইন অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক রোগীর পক্ষে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, প্রয়োজনীয় খরচ বহন, ভাড়া, বিক্রয় বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।  তবে তিনি রোগীর সম্পত্তি নিজের নামে ব্যবহার বা বিক্রি করতে পারেন না আদালতের নির্দেশ ছাড়া। তত্ত্বাবধায়কের ওপর আদালত বার্ষিক হিসাব ও অডিট রিপোর্ট দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক আদালতের অধীনস্থ থাকে। আদালত চাইলে তাঁকে পরিবর্তন করতে পারেন, নতুন কাউকে নিয়োগ করতে পারেন, এমনকি তত্ত্বাবধানে অনিয়ম ধরা পড়লে ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে পারেন। এভাবে আদালত নিশ্চিত করে যে রোগীর সম্পত্তি নিরাপদ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অধীনে আছে।

সরকারের সমাজসেবা অধিদফতর প্রয়োজনে আদালতের নির্দেশে এই সম্পত্তির রক্ষক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষ ক্ষেত্রে সমাজ কল্যাণ বিভাগ মানসিক রোগীর চিকিৎসা ও জীবিকার জন্য সম্পত্তি থেকে অর্থ ব্যয়ের অনুমোদন নিতে পারে।

আইনি দৃষ্টান্ত : বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থায় একাধিক রায়ে (যেমন Abdul Jalil vs. State, 1968, Sailabala Dassi vs. Administrator General, AIR 1932 Cal 734) বলা হয়েছে- “মানসিকভাবে অসামর্থ্য ব্যক্তির সম্পত্তি রক্ষায় আদালতের ভূমিকা কেবল প্রশাসনিক নয়, তা একধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতা।”

মানসিক রোগীর সম্পত্তি রক্ষার প্রশ্নটি শুধুমাত্র আইনি নয়- এটি মানবিক বিষয়ও। বাংলাদেশে বর্তমানে আদালত, সমাজসেবা অধিদফতর এবং পরিবারের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে এই ব্যবস্থাপনা কার্যকর রাখার প্রচেষ্টা চলছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে পরিবার বা আত্মীয়দের অজ্ঞতার কারণে সম্পত্তি অপব্যবহার বা জালিয়াতির শিকার হয়।

আইনজীবীদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত আদালতে আবেদন করে আইনি তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করাই একমাত্র সঠিক উপায়।

পাগল বা মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তির সম্পত্তি সুরক্ষা শুধু আদালতের দায় নয়- এটি সমাজ ও পরিবারের নৈতিক দায়িত্বও। আইন এই ক্ষেত্রে সুরক্ষার পূর্ণ সুযোগ রেখেছে; প্রয়োজন কেবল সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর