বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
অপরাধ ও পুনর্বাসনের বাস্তবতা
মো. আবদুর রহমান মিঞা
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪৩
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অপরাধের ধরন ও মাত্রায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে কিশোর গ্যাং কালচার, নারীর প্রতি সহিংসতা, সাইবার বুলিং এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামাজিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
উচ্চ বেকারত্ব : বিশেষ করে শহুরে ও আধুনিক গ্রামীণ অঞ্চলে যুব সমাজের মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা। চাকরির অভাবে তারা অবসর সময় কাটানোর জন্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়। বেকার যুবকদের মধ্যে মানসিক উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ে, যা সহিংসতা ও অপরাধে রূপ নেয়।
মাদক প্রবণতা : মাদক সেবন ও ব্যবসা দেশের এক বৃহৎ সামাজিক দুর্যোগ। বিশেষ করে কিশোর ও তরুণ সমাজের মধ্যে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক প্রবেশ করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে ত্বরান্বিত করেছে। মাদকাসক্ত যুবকরা অপরাধের জগতে সহজেই প্রবেশ করে।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় : পুরনো দিনের সামাজিক মূল্যবোধ যেমন- নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, পারস্পরিক সম্মান ইত্যাদি দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই মূল্যবোধের আদান-প্রদান হ্রাস পাওয়ায় যুবসমাজের মধ্যে অসংযম, অহংকার ও অবাধ স্বাধীনতার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দ্রুত আর্থিক উন্নতির মানসিকতা : বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার অনেক যুবককে তাৎক্ষণিক সফলতা ও অর্থ আহরণের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে তারা অবৈধ, অবৈজ্ঞানিক ও অবাঞ্চিত উপায়ে দ্রুত অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে যা অপরাধের মূল উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা : অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা ও আধুনিক মানের দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না বা অপরাধীর সক্রিয়তার উল্লেখযোগ্য হ্রাস করা যাচ্ছে না। এতে অপরাধীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং অপরাধ বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে অপরাধীদের পুনর্বাসন নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ খুবই সীমিত। যদিও কিছু কারাগারে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। কারাগারে পুনর্বাসন কার্যক্রমের অভাব রয়েছে। অধিকাংশ কারাগার কেবল শাস্তির স্থান, যেখানে অপরাধীদের মানসিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অপরাধীরা সাধারণত পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের প্রতি সন্দেহ ও অবজ্ঞার কারণে তারা পুনরায় সমাজে ঠিকমতো যুক্ত হতে পারে না। কারাগারমুক্ত ব্যক্তি কর্মসংস্থান ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ না পেয়ে অপরাধমুখী জীবনে ফিরে যায়। পুনর্বাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও কর্মসংস্থানের মতো বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় কার্যকারিতা কমে যায়।
মানসিক অসুস্থ ব্যক্তি, অপরাধী, মাদকাসক্ত বা অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের কাউন্সিলিং বা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজকর্মের স্বীকৃতি প্রদান জরুরি। সমাজকর্ম রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলে সমাজকর্মীরা অপরাথ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন। বাংলাদেশে অপরাধের বাড়বাড়ন্ত অনেকাংশেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণের ফল। অন্যদিকে পুনর্বাসনের অভাবে অপরাধীরা পুনরায় অপরাধ জগতে ফিরে যাচ্ছেন। এজন্য প্রয়োজন সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। শুধু শাস্তি দিয়ে নয়, বরং শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দক্ষ সমাজ কর্মীদের কাউন্সিলিং, মানসিক সেবা এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে অপরাধীদের পুনর্বাসন করতে হবে। এতে বাংলাদেশে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে কার্যকর অবদান রাখা সম্ভব হবে।
অপরাধ ও অপরাধীর মনোসামাজিক মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, অপরাধ কোনো বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র ঘটনা নয়, বরং এটি ব্যক্তি ও সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। একজন অপরাধী কখনো জন্মগতভাবে অপরাধী হয়ে জন্মায় না; তার অপরাধী চরিত্র গড়ে ওঠে নানা সামাজিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবের সংমিশ্রণে। পারিবারিক পরিবেশের অভাব, শৈশবের অভিজ্ঞতা, সামাজিক বৈষম্য, শিক্ষা ও মূল্যবোধের ঘাটতি, আর্থ-সামাজিক হতাশা, এবং মানসিক চাপগুলো তার মনস্তাত্ত্বিক গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে।
অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকে যখন এসব নেতিবাচক প্রভাব একত্রিত হয় এবং অপরাধীকে একটি বিকৃত, বিপথগামী পথে ঠেলে দেয়। এজন্য অপরাধ দমন বা শাস্তি কেবলমাত্র আইন-আদালতের দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র কঠোর শাস্তির মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; বরং অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক পুনর্গঠন এবং সমাজের সামাজিক পুনর্বাসন অপরিহার্য। অপরাধীকে সঠিক দিকনির্দেশনা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং মানসিক সহায়তা প্রদান করলে সে সমাজের একটি গঠনমূলক সদস্য হয়ে উঠতে পারে। এতে করে ব্যক্তির ভেতরে থাকা নেতিবাচক মনোভাব, প্রতিশোধের অনুভূতি ও হতাশা প্রশমিত হয় এবং সমাজের প্রতি তার দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়।
সমাজকে হতে হবে আরো সহনশীল, মানবিক এবং ন্যায়পরায়ণ, যেখানে সংশোধনের সুযোগ ও পুনর্বাসনের পরিবেশ তৈরি হয়। সামাজিক সহমর্মিতা এবং সমঝোতার মাধ্যমে অপরাধীদের পুনরায় সমাজে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হলে অপরাধ প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও সকল সম্প্রদায়কে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। অতএব, অপরাধ দমন নয়, অপরাধ প্রতিরোধই হওয়া উচিত সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। একটি সুস্থ ও সচেতন সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে অপরাধ প্রবণতা জন্ম নেয়ার আগেই সে দমনে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, এবং পরিবার ও সমাজের মেরুকরণ প্রতিরোধে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। যখন ব্যক্তি ও সমাজ একযোগে অপরাধের কারণগুলো দূর করতে উদ্যোগী হবে, তখনই আমরা নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ এবং উন্নত সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারব। অপরাধীকে শুধুমাত্র শাস্তির দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং এক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে সংশোধন ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সামাজিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা সম্ভব। এই ভাবনায় সচেতনতা ও গঠণমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেলে অপরাধহীন সমাজ গঠনের পথে বাংলাদেশ অগ্রসর হবে।
বিকেপি/এমবি

