Logo

আইন ও বিচার

‘ডেথ রেফারেন্স’

মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের আগে বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ যাচাই

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫৭

মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের আগে বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ যাচাই

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় যখন কোনো আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে, তখন সেই রায় কার্যকর হওয়ার আগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চ আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এই অনুমোদনের আইনি প্রক্রিয়াকেই বলা হয় “ডেথ রেফারেন্স” (Death Reference)।

এটি বাংলাদেশের বিচারপ্রণালীর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ধাপ, যেখানে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হবে কি না, তা চূড়ান্তভাবে যাচাই করেন উচ্চ আদালত।

বাংলাদেশে ডেথ রেফারেন্সের বিধান রয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধি (Code of Criminal Procedure, 1898)-এর Section 374 ধারায়।

এই ধারায় বলা হয়েছে- When the Court of Session passes a sentence of death, the proceedings shall be submitted to the High Court Division, and the sentence shall not be executed unless it is confirmed by the High Court Division. অর্থাৎ, কোনো জেলা ও দায়রা জজ আদালত যদি মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন, তবে সেই রায় কার্যকর হওয়ার আগে সেটি অবশ্যই হাইকোর্ট বিভাগে পাঠাতে হবে এবং হাইকোর্টের অনুমোদন ছাড়া রায় কার্যকর করা যাবে না।

কীভাবে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয় :  দায়রা জজ আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর সংশ্লিষ্ট মামলার সমস্ত কার্যবিবরণী, সাক্ষ্য, প্রমাণ ও রায়ের কপি হাইকোর্ট বিভাগে প্রেরণ করেন। মামলাটি তখন হাইকোর্টে Death Reference Case নামে নিবন্ধিত হয়। অভিযুক্ত আসামি চাইলে স্বতন্ত্রভাবে আপিল (Jail Appeal ev Criminal Appeal) করতে পারেন। হাইকোর্ট সাধারণত একযোগে Death Reference এবং আসামির আপিল শুনানি করেন। হাইকোর্টের দুইজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ বিস্তারিত শুনানি শেষে রায় দেন।

হাইকোর্টের এখতিয়ার ও কর্তৃত্ব : হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্সের শুনানিতে নিম্ন আদালতের রায় পুরোপুরি পুনর্মূল্যায়ন করেন। আদালত সাক্ষ্য, প্রমাণ, আইনগত ব্যাখ্যা ও রায় প্রদানের যৌক্তিকতা যাচাই করেন। হাইকোর্ট তিনটি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন- 

মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা, মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আসামিকে খালাস প্রদান। যদি দুই বিচারপতির মতামত এক না হয়, তাহলে মামলাটি তৃতীয় বিচারপতির কাছে পাঠানো হয়; তার মতামতের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত রায় নির্ধারিত হয়।

পরবর্তী ধাপ আপিল বিভাগ : হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলে, আসামির অধিকার থাকে আপিল বিভাগে আপিল করার। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পরও অভিযুক্ত রিভিউ আবেদন করতে পারেন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে দয়া প্রার্থনা করার সুযোগ থাকে- এটি সংবিধানের অৎঃরপষব ৪৯ অনুযায়ী।

বাংলাদেশে ডেথ রেফারেন্স একটি স্বয়ংক্রিয় বিচারিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যেন কোনো ব্যক্তিকে ভুলবশত বা অপর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করা হয়। এই প্রক্রিয়া বিচারব্যবস্থার ন্যায়পরায়ণতা ও মানবাধিকার রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।

সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর গড়ে ৭০ থেকে ১০০টি ডেথ রেফারেন্স মামলা হাইকোর্টে আসে। এর মধ্যে অনুমোদিত মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট রায় পরিবর্তন বা খারিজ করে দেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রে নিচের আদালতে প্রমাণের মান নিম্নমানের হওয়ায় উচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ড রায় টিকে না।

আলোচিত কিছু ডেথ রেফারেন্স : নারায়ণগঞ্জ সাত খুন মামলা (২০১৭) : হাইকোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। ফেনী সোনাগাজী নুসরাত হত্যা মামলা (২০২০): হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স অনুমোদন পায়। রংপুর শিশু ধর্ষণ-হত্যা মামলা: হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করে। এসব উদাহরণে দেখা যায়, হাইকোর্ট কেবল মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য নয়, বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ভারসাম্যপূর্ণ মঞ্চ হিসেবে কাজ করে।

সিনিয়র আইনজীবী শাহ আলম বলেন, ডেথ রেফারেন্স আমাদের বিচারব্যবস্থার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ধাপ। এটি না থাকলে ভুল রায়ে নিরপরাধ মানুষ মৃত্যুদণ্ড পেতে পারত।” অন্যদিকে অ্যাড. জামাল হোসেইন বলেন, ‘প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ড রায় উচ্চ আদালতের যাচাই ছাড়া কার্যকর না হওয়া-এটাই ন্যায়বিচারের মৌলিক নিশ্চয়তা।’

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় “ডেথ রেফারেন্স” শুধু একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং মানবাধিকার সুরক্ষার প্রতীক। এটি বিচারকার্যকে দ্বিতীয়বার যাচাইয়ের সুযোগ দেয়, যাতে ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত ও কার্যকর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর