Logo

আইন ও বিচার

পিতা-মাতার সম্পত্তি এক সন্তানকে লিখে দিলে অন্যদের অধিকার কী?

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৪

পিতা-মাতার সম্পত্তি এক সন্তানকে লিখে দিলে অন্যদের অধিকার কী?

বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ একটি সাধারণ ও জটিল বিষয়। প্রায়ই দেখা যায়, বৃদ্ধ পিতা বা মাতা জীবদ্দশায় তাদের কোনো এক সন্তানকে সমস্ত সম্পত্তি লিখে দেন বা হস্তান্তর করে দেন। তখন অন্য সন্তানদের মধ্যে অসন্তোষ ও আইনি প্রশ্ন দেখা দেয়।

বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় নিজের সম্পত্তি যেকোনো ব্যক্তি বা সন্তানের নামে লিখে দিতে (হেবা/উপহার) পারেন। এটি বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় আইনের আলোকে বৈধ একটি আইনগত কার্যক্রম।

ইসলামী আইনে হেবা : হেবা হলো জীবিত অবস্থায় স্বেচ্ছায় কাউকে সম্পত্তি দান করা। তবে এই হেবা বৈধ হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়-  প্রদান (Offer) : দাতা হেবা দেওয়ার ঘোষণা করবেন; গ্রহণ (Acceptance) :  প্রাপক হেবা গ্রহণ করবেন; দখল (Possession) : প্রাপক সম্পত্তির দখল বা নিয়ন্ত্রণে যাবেন। হেবা একবার বৈধভাবে সম্পন্ন হলে, পরবর্তীতে দাতা তা বাতিল করতে পারেন না, যদি না উভয়পক্ষ সম্মত হন।

হিন্দু ও অন্যান্য আইনে : হিন্দু আইনে পিতা জীবিত অবস্থায় তার সম্পত্তি যেকোনো সন্তানকে দিতে পারেন, তবে পারিবারিক “অংশীদারি” বা “অবিভক্ত সম্পত্তি” হলে তা একতরফাভাবে দেয়া যায় না।

মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার বণ্টন : যদি পিতা বা মাতা জীবদ্দশায় কোনো উইল বা হেবা না দেন, তাহলে তাদের মৃত্যুর পর সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে বণ্টিত হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে প্রতিটি সন্তান (পুত্র ও কন্যা উভয়েই) নির্দিষ্ট হারে সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী। যেমন-পিতা মারা গেলে তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সবাই নির্দিষ্ট অংশ পাবেন। পুত্রের অংশ সাধারণত কন্যার দ্বিগুণ (মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী)। তবে যদি পিতা মৃত্যুর আগে আইনসিদ্ধভাবে হেবা করে সম্পত্তি লিখে দেন, তাহলে সেই সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইনে আর বিতরণের আওতায় আসবে না।

যদি অন্য সন্তানরা আপত্তি করে তাহলে কী করবেন? : যদি কোনো পিতা বা মাতা জীবিত অবস্থায় এক সন্তানকে সম্পত্তি লিখে দেন এবং অন্য সন্তানরা মনে করেন যে, এটি প্রতারণা, জোরপূর্বক হেবা/দলিল তৈরি হয়েছে, অথবা দাতা মানসিকভাবে অসুস্থ অবস্থায় দলিলে সই করেছেন, তাহলে তারা নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারেন :

আইনগত করণীয়: ১. দলিল বাতিলের মামলা যা দেওয়ানি আদালতে করা যায়; দখল পুনরুদ্ধারের মামলা;  ঘুষ, প্রতারণা বা জালিয়াতি প্রমাণিত হলে দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যেতে পারে; আদালত যাচাই করবে দলিলটি স্বেচ্ছায় দেয়া হয়েছে কি না এবং দাতা সম্পূর্ণ মানসিক সক্ষম ছিলেন কি না। আদালত প্রমাণ পেলে যে দলিল প্রতারণা বা চাপ প্রয়োগে করা হয়েছে, সেটি বাতিল ঘোষণা করতে পারেন।

যে সন্তান সম্পত্তি লিখে পেয়েছেন তার করণীয় : যিনি পিতা বা মাতার কাছ থেকে সম্পত্তি লিখে পেয়েছেন, তার উচিত দলিল রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করা, আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রারি করা আবশ্যক;  দখল গ্রহণ করা, সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়া;  মিউটেশন ও রেকর্ড সংশোধন করা- ভূমি অফিসে নামজারি করা; আইনি জট এড়াতে প্রমাণ সংরক্ষণ করা, দলিলের সাক্ষী, দাতার মানসিক সক্ষমতার প্রমাণ, রেজিস্ট্রি রেকর্ড ইত্যাদি।

বাংলাদেশের আদালত বিভিন্ন মামলায় মত দিয়েছে। যদি প্রমাণ হয় দাতা স্বেচ্ছায় ও পূর্ণ মানসিক সক্ষমতায় দলিল দিয়েছেন, তবে তা বৈধ হেবা বা উপহার হিসেবে গণ্য হবে। তবে যদি প্রমাণ হয় প্রতারণা বা চাপ প্রয়োগে দলিল হয়েছে, তাহলে আদালত সেটি বাতিল করতে পারে।

উল্লেখযোগ্য মামলা : গড়ংঃ. ঝঁভরধ কযধঃঁহ াং. অনফঁৎ জধযসধহ (২০১২) মামলায় আদালত রায় দেন। “হেবা বৈধ হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে — ঘোষণা, গ্রহণ ও দখল। এর যেকোনোটি অনুপস্থিত থাকলে হেবা অসম্পূর্ণ ও বাতিলযোগ্য।”

বাংলাদেশে সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক দ্ব›দ্ব থেকে শুরু করে মামলা পর্যন্ত গড়ানো একটি পরিচিত দৃশ্য। অনেক সময় সন্তানদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয় পিতা-মাতার পক্ষপাতিত্বের কারণে। আইনজীবীদের মতে, এ ধরনের সমস্যা এড়াতে প্রয়োজন- পরিবারে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ; আইনজীবীর উপস্থিতিতে হেবা বা উইল তৈরি করা; রেজিস্ট্রেশন ও সাক্ষ্যদানের সময় সব সন্তানকে অবগত রাখা।

পিতা-মাতা তাদের জীবদ্দশায় যেভাবে ইচ্ছা সম্পত্তি লিখে দিতে পারেন এটি তাদের স্বাধীন অধিকার। তবে সেই দলিল স্বেচ্ছায়, বৈধভাবে এবং মানসিকভাবে সক্ষম অবস্থায় করা হতে হবে। অন্য সন্তানদের উচিত ন্যায়বিচারের আশ্রয় নেয়া, কিন্তু পরিবারে সৌহার্দ্য বজায় রাখাও জরুরি। আইন কখনোই বিভাজন নয়, বরং ন্যায় ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উপায়। পরিবারে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই হতে পারে দীর্ঘ মামলা ও সম্পর্কের ক্ষয় থেকে মুক্তির পথ।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর