থানায় পুলিশের ব্যবস্থাপনাকে আলাদা দুটি ভাগে বিভক্ত করার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে মামলার তদন্তের জন্য থাকবে পৃথক শাখা। আর জনশৃঙ্খলা ও আভিযানিক কর্মকাণ্ডে থাকবে আলাদা টিম। যারা মামলার তদন্তে যুক্ত থাকবেন, তারা জনশৃঙ্খলায় যুক্ত হবেন না। আর যেসব কর্মকর্তা জনশৃঙ্খলায় সংশ্লিষ্ট থাকবেন, তাদের কোনো মামলার তদন্তের এখতিয়ার থাকবে না।
প্রস্তাবিত এ পদ্ধতি নিয়ে এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সেখানে স্বরাষ্ট্র, আইন, পরিবেশ-জলবায়ু, গণপূর্ত উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিলেন। এ সময় থানার জনবল কাঠামো নতুনভাবে বিন্যাসের বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এটি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, থানায় তদন্ত ও জনশৃঙ্খলার জন্য আলাদা সেকশন থাকলে মামলার তদন্তের মান বাড়বে। আরো একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারবেন পুলিশ সদস্যরা। অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে না। বাহারুল আলম বলেন, এখন সব থানায় পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে একজন কর্মকর্তা আছেন। তবে তার আওতায় বিশেষ কোনো জনবল নেই। টিম আলাদা করা হলে ১০ থেকে ১২ জন সদস্য একজন পরিদর্শকের (তদন্ত) সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদের বাড়তি জনবল দরকার হবে।
সারা দেশে থানা রয়েছে ৬৩৯টি। ২০২৪ সালে দেশের সব থানায় এক লাখ ৭২ হাজার পাঁচটি মামলা দায়ের হয়। ২০২৩ সালে মামলার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯৫ হাজার ৪৩৬টি। ২০২২ সালে মামলার সংখ্যা ছিল দুই লাখ চার হাজার ২৩০টি। চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে সব থানায় মামলা ১৫ হাজার ৪৩১টি।সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো থানা। অপরাধ বিশেজ্ঞরা বলে থাকেন, যে কোনো দেশের পুলিশ স্টেশন বা থানা হলো পুলিশ বাহিনীর ‘আয়না’। থানার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পুলিশের প্রতি জনসাধারণের ধারণা তৈরি হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে থানার সেবার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। হয়রানির শিকার হন এমন অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। আবার কিছু ঘটনায় বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় পুলিশ।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলা দায়ের, তদন্ত, সাধারণ ডায়েরি (জিডি), পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলসহ নানাকেন্দ্রিক দুর্নীতি ও অনিয়ম থানায় হয়ে থাকে। পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে আশানুরূপ সেবা পাবেন সাধারণ মানুষ। সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য আলাদা দল গঠন করতে হবে। থানা ছাড়া অন্যত্র তাদের বদলি করা যাবে না। ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনায় যুক্ত একটি ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের অধীনে যুক্ত থাকবে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, থানার কার্যক্রমকে দুটি ভাগে বিভক্ত করতে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন তারা। বাহিনীতে ঢোকার জন্য প্রশিক্ষণ শেষে একজন পুলিশ পরিদর্শকের থানায় পদায়নের প্রথম এক বছর থাকে শিক্ষানবিশ কাল। পদায়ন হওয়া সব সদস্য প্রথম তিন বছর জনশৃঙ্খলা ও অপারেশন ইউনিটে কাজ করবেন। এ সময় কোনো এসআই মামলা তদন্ত করতে পারবেন না। তিন বছর পর তাঁকে একটি পরীক্ষায় বসতে হবে। এতে উত্তীর্ণ হলে তদন্ত বিভাগে কাজের উপযুক্ত হবেন তিনি। এরপর চাইলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর তদন্ত ইউনিটে কাজ করতে পারবেন। এই পাঁচ বছরে তাঁকে দুবার পরীক্ষা দিতে হবে। অকৃতকার্য হলে তাঁকে পুনরায় তদন্ত ইউনিট থেকে অপারেশন বা জনশৃঙ্খলা ইউনিটে পাঠানো হবে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, থানায় কেউ পাঁচ বছর সফলতার সঙ্গে তদন্ত ইউনিটে কাজ করলে তাঁকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) পাঠানো হবে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে কোনো মামলা হলে তার তদন্তের দায়িত্ব পৃথক সেকশনে চলে যাবে। ওই টিমের সদস্যরা এটি দেখভাল করবেন। মামলায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করবেন। আবার প্রয়োজনে গ্রেপ্তারে অপারেশনাল ইউনিটের সহযোগিতা নেবেন। থানার আওতাভুক্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, নাগরিক অভিযোগ আমলে নেওয়া, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়নে পুরোপুরি সম্পৃক্ত থাকবেন অপারেশন বিভাগের সদস্যরা। যারা ১৩ বছর তদন্তের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, তারা পরবর্তী সময়ে পরিদর্শক হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। বর্তমানে উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শকরা মামলার তদন্ত করে থাকেন। সাধারণ কোর্ট পিটিশন অভিযোগের তদন্ত করেন সহকারী উপপরিদর্শকরা।
সূত্র বলছে, পুলিশের অন্তত ২০ হাজার এসআই (নিরস্ত্র) এবং পাঁচ হাজার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) পদমর্যাদার তদন্ত কর্মকর্তা আছেন। তারা ফৌজদারি অপরাধের কোনো মামলার তদন্ত, আলামত সংগ্রহ, অপরাধী গ্রেপ্তার, মালপত্র উদ্ধার, আসামি হেফাজতে নেয়া, আদালতে সোপর্দ, রিমান্ড চাওয়া, প্রতিবেদন দাখিলসহ তদন্তসংশ্লিষ্ট নানা কাজে যুক্ত। এ ছাড়া অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশে রয়েছে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব, কেমিক্যাল ল্যাব, আইটি ল্যাব, হস্তলেখা ও হস্তরেখা বিশারদ। বিভিন্ন ল্যাবে নতুন উপায়ে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছে পুলিশ।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় সাজার হার খুব কম। ৮০-৯০ ভাগ মামলায় আসামিরা ছাড়া পায়। অনেক সময় আসামির সাজা না হওয়ার কারণ হিসেবে পুলিশের দুর্বল তদন্ত ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। তবে চূড়ান্ত সাজা কেবল পুলিশের তদন্তের মানের ওপর নির্ভর করে না। সাক্ষী হাজিরার বাইরে পুলিশের তেমন কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। ২০০৮ সাল থেকে নি¤œ বা উচ্চ– সব আদালতেই মামলা পরিচালনা করেন সরকারের অস্থায়ী নিয়োগ পাওয়া এপিপি ও পিপিরা। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সবাইকে দক্ষ করে তুলতে না পারলে অপরাধ প্রমাণ করে সাজার হার বাড়ানো কঠিন।
বিকেপি/এমবি

