Logo

আইন ও বিচার

জজকোর্টের একটি অদ্ভুত সংস্কৃতি ‘আদেশ হবে’

Icon

মো. তানভীর আহমেদ

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৪১

জজকোর্টের একটি অদ্ভুত সংস্কৃতি ‘আদেশ হবে’

যেসব আইনজীবী নিয়মিত জজকোর্টে যান, তারা ফৌজদারি ও দেওয়ানী উভয় মামলায় অনেক সময় মক্কেলের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কারণ, উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিজ্ঞ আদালত যখন বলেন-“আদেশ হবে” অথবা “নথি পর্যালোচনা পূর্বক আদেশ” অথবা “পরে আদেশ”। অর্থাৎ, আদেশটি প্রকাশ্যে কোর্টে না দিয়ে জজ সাহেব চেম্বারে বসে বিচার-বিশ্লেষণ শেষে প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে প্রায়ই মক্কেল শুনানি শেষে আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন “কি আদেশ হলো ?”

আইনজীবী তখন কিছুটা বিব্রত হয়ে বোঝান- “আদেশ হয়নি, বিজ্ঞ কোর্ট আদেশ পরে দিবেন।” বিজ্ঞ আদালতের এমন সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষের আদালতের প্রতি কিছুটা আস্থা কমে এবং সন্দেহের জন্ম নেয়।

বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জামিন শুনানির পর “আদেশ হবে” বলে জামিনের আদেশ বিলম্ব করে চেম্বার থেকে দেওয়া হতো। অন্যদিকে, দেওয়ানী মামলার গুরুত্বপূর্ণ আদেশের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতো, এক্ষেত্রে বিজ্ঞ জজ সাহেব আদেশের স্থান ফাঁকা রেখে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে আদেশ প্রদান করতেন।

আমি ভেবেছিলাম ৫-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু গত কয়েক মাস জজকোর্টের মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখলাম এ ধরনের প্রবণতা আরো বেড়েছে।

গত ১৮/০৮/২০২৫-ইং তারিখে ঢাকায় একটি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় শুনানি শেষে আদালত বলেন— “আদেশ হবে।” ভুক্তভোগী আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি জানাই বিকালে আদেশ দেওয়া হবে। এর আগে গত মাসে একটি দেওয়ানি মামলায়ও একই অভিজ্ঞতা হধয়েছে- শুনানি শেষে বলা হয়েছিল “আদেশ হবে”, পরে তিন সপ্তাহ পর কজ লিস্টে আদেশ আসে, পূর্ণাঙ্গ আদেশ এখনো পাওয়া যায়নি। আরো আগে অন্য একটি দেওয়ানি মামলায়ও একই ঘটনা। আমাদের মনে রাখা উচিত, এমনটি হওয়ার কারণ যাচাই করার জন্য কিছু বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে তিনটি কারণ উঠে আসে- ১. শুনানি শেষে বিচারক নথি পর্যালোচনার জন্য সময় চান, তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। ২. বিচারকের কোনো অনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ৩. উচ্চ মহলের চাপ বা প্রভাবের কারণে তিনি তাৎক্ষণিক আদেশ দিতে পারেন না।

প্রথম কারণটি যুক্তিসঙ্গত হলেও, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কারণ মানতে কষ্ট হয়। এজন্য আমি প্রাক্তন জেলা জজ এবং বর্তমান সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহজাহান সাজুর মতামত জানতে চাই। তিনি বলেন- গুরুত্বপূর্ণ আদেশ বা রায় কখনোই চেম্বার থেকে দেয়া উচিত নয়। সময়ের প্রয়োজন হলে বিচারক নির্ধারিত দিনে প্রকাশ্যে আদালতে আদেশ বা রায় দেবেন, সেটিই কাম্য।

আইন কী বলে? : দুর্নীতি দমন কমিশন বনাম পার্থ গোপাল বনিক ও অন্যান্য (ফৌজদারি আপিল নং ৪৬৮৮/২০২১)-এ হাইকোর্ট বিভাগ বলেছে- স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নি¤œ আদালতের বিচারকদের জামিনসহ অন্তর্বর্তীকালীন গুরুত্বপূর্ণ আদেশ ও রায় প্রকাশ্য আদালতে সংশ্লিষ্ট পক্ষ বা আইনজীবীদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করতে হবে।

এরপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয় এবং হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার গত ২৮/০৯/২০২১-ইং তারিখে একটি স্মারকের মাধ্যমে অধস্তন আদালতসমূহকে অবহিত করেন। অর্থাৎ, নিম্ন আদালত এ নির্দেশনা মানতে বাধ্য। এই লেখাটি কোনো নির্দিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়। এটি নিম্ন আদালতের প্রচলিত একটি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, যা সরাসরি উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী। বিচারপ্রার্থীদের আস্থা ও স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য- যাতে সাধারণ মানুষের মনে বিচারব্যবস্থা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি না হয়।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর