Logo

আইন ও বিচার

সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে গরমিল

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৬

সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে গরমিল

বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড, আত্মহত্যা, অস্বাভাবিক মৃত্যু বা সন্দেহজনক মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম যে দুটি সরকারি নথি তৈরি হয় তা হলো সুরতহাল রিপোর্ট এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ নথির মধ্যে অসঙ্গতি বা গরমিল দেখা দেয়— যা অনেক সময় বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে।

সুরতহাল রিপোর্ট : ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৭৪ অনুযায়ী, কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু (যেমন- হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, বা সন্দেহজনক মৃত্যু) ঘটলে থানার অফিসার-ইন-চার্জ বা তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাশের প্রাথমিক অবস্থা, আঘাত, পোশাক, পরিবেশ, আলামত ইত্যাদির বর্ণনাসহ একটি রিপোর্ট তৈরি করেন- এটিই “সুরতহাল রিপোর্ট”। এটি এক ধরনের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট, যা পুলিশের মাধ্যমে প্রস্তুত হয়।

ময়নাতদন্ত রিপোর্ট : মৃতদেহ হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হলে, চিকিৎসক কর্তৃক শারীরিকভাবে পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের রিপোর্টই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। এটি ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করেন, যেটি আদালতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয়।

দুই রিপোর্টে গরমিল বলতে কী বোঝায় : গরমিল বলতে বোঝায়  সুরতহালে মৃত্যুর ধরন “আত্মহত্যা” বলা হলেও, ময়নাতদন্তে “হত্যা” বলা হয়েছে। সুরতহালে “গলায় দাগ নেই” বলা, কিন্তু ময়নাতদন্তে “শ্বাসরোধে মৃত্যু” উল্লেখ থাকা। সুরতহালে আঘাতের সংখ্যা বা স্থানে পার্থক্য। সুরতহালে উল্লেখিত পোশাক, আলামত বা আঘাত ময়নাতদন্তে অনুপস্থিত। এই ধরনের অসঙ্গতি আদালতের কাছে তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (ধারা ১৭৪ ও ১৭৬) : ধারা ১৭৪ অনুযায়ী, ওসি কর্তৃক তৈরি করা সুরতহাল রিপোর্ট আদালতে পাঠাতে হয়। যদি আদালত মনে করে সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে গরমিল আছে, তবে ধারা ১৭৬ অনুযায়ী Judicial Inquiry বা বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেট তখন স্বতন্ত্রভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সাক্ষ্যগ্রহণ ও নতুন প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেন।

দণ্ডবিধি, ১৮৬০ অনুযায়ী (Sections 167, 193, 465, 471): যদি প্রমাণিত হয় যে, পুলিশ কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বা বিকৃত তথ্যসহ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেছেন, অথবা চিকিৎসক পক্ষপাতমূলক বা ভুল ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিয়েছেন, তাহলে তারা নিম্নলিখিত অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন।

ধারা অপরাধ সর্বোচ্চ শাস্তি : ১৬৭ সরকারি কর্মকর্তা দ্বারা ভুল তথ্য প্রদান ৩ বছর কারাদণ্ড, ১৯৩ আদালতে মিথ্যা প্রমাণ প্রদান ৭ বছর কারাদণ্ড, ৪৬৫ জাল রিপোর্ট তৈরি ২ বছর কারাদণ্ড, ৪৭১ জাল রিপোর্ট ব্যবহার ৭ বছর কারাদণ্ড

আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি ও রায়ের নজির : State vs. Dr. Jasim Uddin (2019, Dhaka HC): আদালত বলেন

“সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টের গরমিল গুরুতর তদন্ত ব্যর্থতা। তদন্ত কর্মকর্তা বা চিকিৎসক ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তা ন্যায়বিচার ব্যাহত করে।”

State vs. Inspector Rafiq (2021) : “ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, এটি সুরতহালের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে গরমিল থাকলে আদালত পুনঃতদন্ত বা Judicial Inquiry নির্দেশ দিতে পারেন।”

বাংলাদেশের অনেক আলোচিত মামলায় (বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যা, বা আত্মহত্যা মামলা) দেখা যায়, সুরতহালে “গলায় দড়ির দাগ দেখা গেছে” বলা হলেও, ময়নাতদন্তে “শ্বাসরোধ নয়, বিষক্রিয়া” বলা হয়। এ ধরনের পার্থক্য আসামির দোষ প্রমাণে বিলম্ব বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

একটি গবেষণায় (ল’ কমিশন, ২০২২) দেখা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০০টিরও বেশি মামলায় সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে গরমিল পাওয়া যায় এবং প্রায় ৩০% ক্ষেত্রে আদালত পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন।

ভুক্তভোগী বা স্বজনদের করণীয় : বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন করুন: আদালতে লিখিতভাবে আবেদন করে CRPC ১৭৬ ধারা অনুসারে Judicial Inquiry চাওয়া যায়। পুনঃময়নাতদন্ত (Re-postmortem) চাওয়া।  আদালত প্রয়োজনে লাশ পুনরায় উত্তোলন করে নতুন ময়নাতদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।

অভিযোগ দায়ের : যদি সন্দেহ হয় রিপোর্ট ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা হয়েছে, তাহলে দণ্ডবিধি ১৯৩, ১৬৭, ৪৬৫ ধারায় মামলা করা যায়। মেডিকেল বোর্ডের মতামত : আদালত চাইলে এক্সপার্ট মেডিকেল বোর্ডের পর্যালোচনা রিপোর্ট নিতে পারেন।

অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, সুরতহাল রিপোর্ট প্রাথমিক প্রমাণ মাত্র, কিন্তু ময়নাতদন্ত হলো বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতিফলন। দুইয়ের মধ্যে গরমিল থাকলে আদালতকে সত্যের পক্ষে যেতে হবে। ডা. ফরিদা আখতার, ফরেনসিক এক্সপার্ট বলেন, পুলিশ বা চিকিৎসক উভয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই গরমিল ঘটে। অনেক সময় সময়ের ব্যবধান ও তদন্তের গাফিলতিও এর কারণ।

সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে গরমিল ফৌজদারি কার্যবিধি ১৭৪, ১৭৬ Judicial Inquiry বা Re-investigation আদালতের আদেশে পুনঃতদন্ত, ইচ্ছাকৃত ভুল রিপোর্ট দণ্ডবিধি ১৬৭, ১৯৩ ফৌজদারি মামলা দায়ের ৩-৭ বছর জেল

পুনঃময়নাতদন্ত আদালতের নির্দেশে নতুন ফরেনসিক রিপোর্ট প্রমাণ পুনর্মূল্যায়ন, তদন্তে অনিয়ম প্রশাসনিক ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গ মামলা সাময়িক বরখাস্ত/চাকরিচ্যুতি

সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে গরমিল মানেই তদন্তে দুর্বলতা। এটি শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক ত্রæটি নয়, এটি বিচার ব্যাহত করার শামিল, যদি তা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটে।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, গরমিল প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বা চিকিৎসক উভয়েই ফৌজদারি অপরাধের অভিযুক্ত হতে পারেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে স্বচ্ছতা, সমন্বয় ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এখন সময়ের দাবি।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর