Logo

আইন ও বিচার

লকডাউন ঘোষণা

রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা নাকি আইনি সীমা?

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২৬

রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা নাকি আইনি সীমা?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল “লকডাউন” বা “অবরোধ” আহ্বান করে সরকারবিরোধী কর্মসূচি হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়- “লকডাউন” শব্দটি আইনত কোন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করতে পারে? রাজনৈতিক দল বা নাগরিক সংগঠন কি এই ক্ষমতা রাখে, নাকি এটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের একচেটিয়া অধিকার?

বাংলাদেশে ‘লকডাউন’ শব্দটি মূলত ব্যবহৃত হয় জনস্বাস্থ্য, জরুরি অবস্থা বা প্রশাসনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা হিসেবে। এই শব্দটি কোনো রাজনৈতিক শব্দ নয়, বরং এটি আইনি ও প্রশাসনিক পরিভাষা। প্রযোজ্য আইনসমূহে লকডাউন সংক্রান্ত ক্ষমতা ও প্রক্রিয়া নির্ধারিত আছে।

সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ (Infectious Diseases Act, 2018)

এই আইনের ১১ ও ১২ ধারা অনুযায়ী, সরকার বা জেলা প্রশাসক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা অনুমোদিত সরকারি কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে লকডাউন ঘোষণা করতে পারে। কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা রাজনৈতিক দলকে এই আইনে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ (Disaster Management Act, 2012) : জরুরি পরিস্থিতি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সরকার, জেলা প্রশাসন বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন বা মুভমেন্ট কন্ট্রোল করতে পারে।

বাংলাদেশ সংবিধান, অনুচ্ছেদ 141(A-C) : এখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রপতির, রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি নয়। অতএব, আইনগতভাবে “লকডাউন ঘোষণা” করার ক্ষমতা শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের, কোনো রাজনৈতিক দল বা নাগরিক সংগঠনের নয়।

রাজনৈতিক দলের লকডাউন ঘোষণা : রাজনৈতিক দল যদি “লকডাউন” শব্দ ব্যবহার করে রাজনৈতিক আন্দোলন বা প্রতিবাদ কর্মসূচি হিসেবে জনসমাবেশ, পরিবহন বন্ধ বা দোকানপাট বন্ধ রাখার আহ্বান জানায়, তা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত সভা, সমাবেশ ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের স্বাধীনতার আওতাভুক্ত হতে পারে তবে এর সীমা আছে।

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “মত প্রকাশের স্বাধীনতা আইন দ্বারা যুক্তিসঙ্গতভাবে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে যদি তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।” অর্থাৎ, রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ কর্মসূচি দিতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম স্থবির করে দেয়া, জনজীবন অচল করা বা নিরাপত্তা বিপন্ন করা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।

বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক মঞ্চে বড় দুইটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলছে: এক পক্ষ হলো-  রাজনীতি ও সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গণভোট বা প্রজাতান্ত্রিক নিয়মে বড় পরিবর্তন আনা; অন্য দিকে হলো- সংসদীয় সরকারের পরিবর্তে বা তার চেয়ে আগে অন্তর্বর্তীকালীন (interim) সরকার ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান, আইন ও রাজনীতি একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জটিল একটি অবস্থা সৃষ্টি করেছে।

সংসদীয় সরকার ও সাধারণ নির্বাচন : The Constitution of the People Republic of Bangladesh (বাংলাদেশ সংবিধান) মূলত সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)(ন) অনুসারে, যদি সংসদ সময়ে (term) শেষ হওয়ায় না ভেঙে যায়, তাহলে সংসদ ভঙ্গের পর ৯০ দিনের ভেতরে সাধারণ নির্বাচন করা হবে। তবে উল্লেখযোগ্য যে, সংবিধানে “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার” (interim government) নামে কোনো স্পষ্ট ধারা নেই। 

 কেয়ারটেকার (Caretaker) সরকার ব্যবস্থা : ১৯৯৬ সালে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনের (13th Amendment) মাধ্যমে “নন-পার্টি কেয়ারটেকার সরকার” ব্যবস্থা চালু হয় যার অধীনে সাধারণ নির্বাচন পর্যায়ে সরকারের দায়িত্ব পার্টি নিরপেক্ষভাবে হস্তান্তর করার লক্ষ্য ছিল। তবে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংশোধনের মাধ্যমে এই কেয়ারটেকার ধারা বাতিল করা হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন এই ধারা বাতিল করাই নির্বাচনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা সংকটের প্রধান কারণ।

এর আগ আমরা দেখেছি রাজনৈতিক দলগুলো সম্প্রতি একমত হয়েছেন যে, সংবিধানের বড় ধারা যেমন-ধারা ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২  সংশোধনের ক্ষেত্রে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে অনুমোদন হওয়া উচিত। গুরুত্বপূর্ণ হলো, রেফারেন্ডামের বিধান সংবিধানে খুব সীমিত ছিল এবং “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার” বা “ইন্টারিম গভার্নমেন্ট” ধারা সংবিধানে নেই।

বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। তবে আইনগতভাবে এটি সংবিধানে নিকট ঠিকঠাক ধরা পড়ে না- সংবিধানে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া নেই। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৬ অনুযায়ী দেশের সর্বোচ্চ আদালত-আপিলেট বিভাগে আইনগত মতামত চেয়ে একটি রেফারেন্স পাঠিয়েছিলেন। 

বিচারিক-বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের গঠনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে “অত্যাবশ্যকতা (Doctrine of Necessity) ধরনায় এবং জনগণের মঞ্চ থেকে উদ্ভূত প্রশ্নে।

যদি বড় ধরনের সংবিধান সংশোধন, বিশেষ করে প্রাক্তন কেয়ারটেকার সিদ্ধান্ত পুনর্বহাল করা হয় অথবা পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলসমূহ একমত হয়েছেন যে রেফারেন্ডাম বা গণভোট করা জরুরি। গণভোটের মাধ্যমে সাধারণ জনমতের অধিকার প্রতিষ্ঠার ধারণাগত শক্তি রয়েছে নির্বাচন-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, জনগণের অংশগ্রহণ ও সুবিধার্থক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে।তবে বাস্তবায়নে একাধিক চ্যালেঞ্জ থাকবে যেমন রেফারেন্ডামের আইনগত ভিত্তি, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, তথ্যপ্রচারের পরিবেশ, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ।

সংবিধানের দৃষ্টি থেকে পার্লামেন্টই মূলভাবে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করবার ক্ষমতা রাখে (ধারা ১৪২ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের অধিকার রয়েছে)। তবে পার্লামেন্টীয় পরিবর্তন ঘটাতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা, সংবিধান সংশোধনের জন্য ২/৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই পথ তুলনায় বেশি আইনগত এবং সংবিধান-অনুগত বলেই বিবেচিত হয়।

বর্তমানে যদি নিয়মিত নির্বাচনের আয়োজন কঠিন হয়, রাজনৈতিক অবস্থা অস্থির হয় অথবা শাসনব্যবস্থা সংকটপূর্ণ হয়- তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি সম্ভাব্য ধাপ হতে পারে। তবে সংবিধানে নির্ধারিত ধারা না থাকলে এ ধরনের গঠন “অতিরিক্ত সংবিধানিক” বা “চরম অবস্থার” (extra-constitutional) ভিত্তিতে পরিচালিত হতে পারে। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হলেও, গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রক-চেকস এবং সময়সীমা থাকলে ভঙ্গুরতা বাড়ে। 

২০২৪ সালের আগস্টে দেশে একটি বড় ছাত্র-জনমত বিক্ষোভের পর,পার্লামেন্ট ভঙ্গ হয় এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। নতুন সরকারকে আইনগত ভিত্তি দেয়ার জন্য আদালতে রেফারেন্স করা হয় এবং আদালত কিছু অংশে এই গঠনকে বৈধতা দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলসমূহ এখন সংবিধান সংশোধন ও রূপান্তরের লক্ষ্যে আলোচনায় রয়েছে এবং রেফারেন্ডামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একমত হয়েছে। 

গণভোট বা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক একটি নতুন মঞ্চ গঠন এবং জনপ্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সম্ভব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন এবং সংবিধান পুনর্গঠনের জন্য সময় ও পরিবেশ সাজাতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় জড়াতে পারলে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে সমাধানে যেতে পারে।

সংবিধানগত পরিষ্কার ধারা না থাকলে আইনগত ও বিচারিক চ্যালেঞ্জ বাড়ে। যেমন- দায়িত্ব, সময়সীমা, নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা। গণভোটের পরিবেশ যদি স্বচ্ছ না হয়, দল-দ্ব›দ্ব বা তথ্যচলাচলে প্রশ্ন থাকলে ফলস্বরূপ বৈধতা সংকট হতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অমেয় নিয়ন্ত্রণ বা সময়সীমার অব্যাহততা হলে গণতান্ত্রিক ব্যাকল্যাশ সৃষ্টি হতে পারে। পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা দুর্বল হলে যেমন- দলীয় নোমিনেশন, শাসক-পক্ষের একক আধিপত্য  সেক্ষেত্রে পরিবর্তন স্বয়ং বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিকল্প সামনে রয়েছে- গণভোট ও সংবিধান সংশোধন, অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমানে স্পষ্ট ও স্বীকৃত “ইন্টারিম গভার্নমেন্ট” ধারা নেই। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পথে যাওয়া রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে এবং বিচারিকভাবে কিছু নির্ধারণ পেয়েছে। খুব বড় ধরণের সংবিধান সংশোধন বা পার্লামেন্টীয় কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে গেলে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনমতের সহমত নেয়া উত্তম হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে সেটিকে স্পষ্ট সময়সীমা ও নিয়ন্ত্রণ-মেকানিজমসহ গঠন করতে হবে যাতে শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়। নির্বাচন কমিশন, বিচারপতি আদালত, সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে যাতে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়।

রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করতে হবে সংলাপ ও সমঝোতায় পার্থক্য থাকলেও রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর