Logo

আইন ও বিচার

গণভোট নাকি সংসদ!

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন মূল প্রশ্ন

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:০৯

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন মূল প্রশ্ন

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নতুন মোড় নিয়েছে। দীর্ঘদিনের দলীয় বিরোধ, আন্দোলন-সংঘাত ও গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এখন প্রশ্ন উঠেছে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন হবে, নাকি সংসদই করবে সেই কাজ? এর আগে সংবিধানে অনুপস্থিত “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার” ব্যবস্থার বৈধতা ও সীমা নিয়েও চলছিল তুমুল বিতর্ক।

বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা একটি সংসদীয় গণতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)(ন)-এ বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে গেলে নবগঠনের জন্য ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। তবে সংবিধানের কোথাও “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার” বা “ইন্টারিম গভার্নমেন্ট”-এর কোনো ধারা নেই। ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনের মাধ্যমে “নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার” চালু হলেও, ২০১১ সালে তা বাতিল করা হয়। ফলে বর্তমানে সংবিধান অনুযায়ী কেবলমাত্র নির্বাচিত সংসদই রাষ্ট্র পরিচালনার সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে। তবে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রেফারেন্ডাম বা গণভোটের মাধ্যমে জনমতের অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে- এমন মত এখন রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “গণভোট হবে একটি জনগণভিত্তিক গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। এতে সাধারণ নাগরিকরা সরাসরি সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবেন।”

সংসদীয় ব্যবস্থায় সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। 

বর্তমান বাস্তবতায় সংসদে এমন ঐক্য গঠন কঠিন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে গণভোটের পক্ষে মত দিচ্ছেন কিছু জাতীয় রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠন। তাদের মতে, সংসদীয় পক্ষপাতহীনতা নিশ্চিত করতে গণভোটই হতে পারে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান।

তবে সংবিধানবিদ ড. শাহদীন মালিকের ভাষায়- 

“গণভোট করতে হলে আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। সংসদ যদি সে কাঠামো না করে, তাহলে তা হবে অসাংবিধানিক।”

২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ব্যাপক আন্দোলন-সংঘাতের পর সংসদ ভেঙে যায় এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government) গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৬ অনুযায়ী আপিল বিভাগে মতামত চান এই সরকারের বৈধতা বিষয়ে। আদালত Doctrine of Necessity বা অত্যাবশ্যকতার তত্ত্বে ভিত্তি করে সরকারের অস্তিত্বকে সীমিতভাবে বৈধ ঘোষণা করেন।

তবে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি “অতিরিক্ত-সংবিধানিক (Extra-Constitutional)” ব্যবস্থা, যা দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

২০২৪ সালের আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন সংবিধান সংস্কারের রোডম্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো একাধিক বৈঠকে একমত হয়েছে যে, ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন বা তত্ত্বাবধায়ক ধারা পুনর্বহাল করা হলে তা গণভোটের মাধ্যমে জনমতের ওপর নির্ভরশীল করা হবে।

গণভোটের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ তৈরি করতে পারে। নতুন সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া রাজনৈতিক ঐক্য ও গণতান্ত্রিক সংস্কার ত্বরান্বিত করবে। সংবিধানিক ভিত্তি অনির্দিষ্ট থাকলে আইনি চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দীর্ঘস্থায়িত্ব গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারে। গণভোটের পরিবেশ স্বচ্ছ না হলে তার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেইে মনে করেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারে এবং জনগণ কতটা বিশ্বাস পায় সেই প্রক্রিয়ায়।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সংবেদনশীল মোড়ে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গণভোট বা সংসদীয় অনুমোদন- উভয় পথই আইনগতভাবে সম্ভব, তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনবিশ্বাসই মূল চাবিকাঠি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর এখন দায়িত্ব সেই বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা এবং নতুন সংবিধান সংস্কারের পথে একটি সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি তৈরি করা।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর