Logo

আইন ও বিচার

সমুদ্র আইন ও বাংলাদেশের নীল অর্থনীতি

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৫৪

সমুদ্র আইন ও বাংলাদেশের নীল অর্থনীতি

বাংলাদেশের সমুদ্রভিত্তিক আইন ও নীতি- অর্থাৎ সমুদ্র আইন- দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সাম্প্রতিক দশকে আন্তর্জাতিক আদালত ও ত্রৈপর্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপসাগরে জাতীয় সীমা স্থির হওয়ায় বাংলাদেশ নির্দিষ্ট আইন ও নীতির ভিত্তিতে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচেটিয়া অবাধ্যতা (EEZ) ও কন্টিনেন্টাল শেলফে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।

এসব আইনি-মৌলিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে মৎস্য, জ্বালানি ও সমুদ্র-সম্পদ থেকে 'ক্ল ইকোনমি' বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে পরিবেশ, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জও বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশে সমুদ্রভিত্তিক অধিকার, সীমা ও জোন নির্ধারণে মূলত The Territorial Waters and Maritime Zones Act (প্রাথমিক: ১৯৭৪) এবং পরবর্তীতে সংশোধনী/নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে ২০২১ সালের সংশোধনী বা নতুন আইন-স্থাপনা জাতীয় আইনকে বাস্তবে UNCLOS (জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছে এবং দেশের EEZ ও কন্টিনেন্টাল শেলফ সংক্রান্ত বিধানকে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে

আন্তর্জাতিক আইন : বাংলাদেশ UNCLOS-এ বাধ্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: আন্তর্জাতিক সনদে বর্ণিত বিধি (যেমন সামুদ্রিক সীমা, EEZ, কন্টিনেন্টাল শেলফ) প্রয়োগ করে সীমা-বিলম্বন ও সম্পদ-অধিকার নির্ধারণ করেছে। দেশের সীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালত ও ট্রাইব্যুনাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিরোধ (ITLOS, 2012) : আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের প্রতিষ্ঠান ITLOS 2012 সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সীমা-বিচ্ছেদ (delimitation) বিষয়ে রায় প্রদান করে। এর ফলে উভয় দেশের সমুদ্রজায়গা নির্ধারিত হয়। এই রায় বাংলাদেশের কন্টিনেন্টাল শেলফ ও EEZ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ-ভারত বিতর্ক (আর্বিট্রেশন/ট্রিবিউনাল, ২০১৪) : ২০১৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমা-নির্ধারণে স্থায়ী আরবিট্রোল পুরস্কার (award) জানানো হয় যার ফলে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকালের ওপেন সীমাসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা কাটে এবং বাংলাদেশ প্রচুর সমুদ্র জায়গায় ইচ্ছেমত প্রয়োগযোগ্য অধিকার অর্জন করে। এই দুটি রায় বাংলাদেশের সমুদ্রভিত্তিক অঞ্চল নির্ধারণে যুগান্তকারী।

তীররেখার দৈর্ঘ্য : বাংলাদেশে সমুদ্রতীর প্রায় ৭১০ কিলোমিটার মাপা হয়। উউত ও কন্টিনেন্টাল শেলফের আয়তন সীমা নির্ধারণের পর দেশের কাছাকাছি অর্জিত সামুদ্রিক এলাকার মূল্যায়ন অনুসারে বাংলাদেশ প্রায় ১১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রজায়গার অধিকার অর্জন করেছে যা দেশের স্থলভাগের শতকের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। (নির্ভরযোগ্য নকশা ও গবেষণা আলোকে ভিন্ন উৎসে ভিন্ন সূচিত সংখ্যা থাকতে পারে। তবে সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নীল সম্পদের পরিধি ব্যাপক)।

আভ্যন্তরীণ জল (Internal waters) : দেশের সাধারণ সর্বভুক্ত জলসীমানা (বন্দর, নদীর মুখ ইত্যাদি) সম্পূর্ণরূপে দেশের সার্বভৌমতু। সাংবিধানিক মর্যাদাসম্পন্ন আঞ্চলিক সীমা ১২ নটিক্যাল মাইল (Torritorial sea) পূর্ণ সার্বভোগ্যতা তবে প্রবেশিকর্তারা নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক নেভিগেশন অধিকার পালনে সক্ষম। সংলগ্ন অঞ্চল (Contiguous zone)- ২৪ নটিক্যাল মাইল শুদ্ধ, বহির্মুখী অপরাধ প্রতিরোধে। সীমিত ক্ষমতা।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (EEZ) ২০০ নটিক্যাল মাইল- জাতীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম (মৎস্য, খনিজ) পরিচালনার একচেটিয়া অধিকার। কন্টিনেন্টাল শেলফ- সমুদ্রতল ও ভূতত্ত্বগত উপকরণে গভীর খনিজ ও শক্তি সম্পদ উত্তোলনের অধিকার।

বাঙলাদেশের বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের প্রধান মৎস্য আহরণ ক্ষেত্র। সীমা নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হলে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের আয় বাড়াতে এবং রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়েছে। তেল ও গ্যাস/মৌলিক খনিজ: কন্টিনেন্টাল শেলফে অন্বেষণ কার্যক্রম (seismic surveys, exploratory drilling) বৃদ্ধি পেলে দেশীয় জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সাপোর্ট বাড়বে। তবে পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনা জরুরি।পর্যটন ও নৌপরিবহন- সমুদ্রভিত্তিক কৌশলগত বন্দরে বিনিয়োগ ও মারিটাইম সার্ভিস উন্নয়ন দেশের অর্থনীতিকে সুফল দেবে

মূল চ্যালেঞ্জসমূহ : পরিবেশগত সংকট ও দূষণ। সমুদ্র দূষণ, প্লাস্টিক, তৈল-ভ্রষ্টতা, নদী-মেঘনা সিস্টেমের ল্যান্ড-সমুদ্র যোগাযোগের মাধ্যমে উপসাগরের পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত ও অজ্ঞাত (ILL)) মৎস্য আহরণ-প্রতিবছর অবৈধ ঢেউ ও ট্রলার-অভিযান স্থানীয় মৎস্যশিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পর্যাপ্ত আইন-প্রয়োগ কাঠামো ও পর্যাপ্ত প্রযুক্তি-ক্ষমতার অভাব-মোবাইল মনিটরিং, সার্ভেইল্যান্স ও সমুদ্রপাগল্য রোধে সক্ষমতা বাড়াতে হবে (কোস্ট গার্ড, নেভি, মেরিটাইম এডমিন), জ্বালানি অন্বেষণ বনাম পরিবেশের টানাপোড়েন- খনিজ অনুসন্ধান, উৎপাদনে পরিবেশগত মূল্যায়ন অপরিহার্য।

ভূসমুদ্র পরিকল্পনা (Marine Spatial Planning) : উপকূলীয় ও সমুদ্র জোনগুলোর ব্যবহার (মৎস্য, খনি, পরিবহন, সংরক্ষণ) ইন্টিগ্রেটেডভাবে নির্ধারণ করতে জাতীয় গরুচ অবিলম্বে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। কাঠোর পরিবেশগত মূল্যায়ন ও গড়া (Marine Protected Areas): সংবেদনশীল জৈববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট গচঅ ঘোষণা ও কার্যকর নজরদারির ব্যবস্থা।

আইন-প্রয়োগ ক্ষমতা বাড়ানো : কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়, আধুনিক পেট্রোল বোট, স্যাটেলাইট মনিটরিং গ্রহণ। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের অন্তর্ভুক্তি ও দক্ষতা বিকাশ- সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ ও টেকসই জাল, সীমানা-জানার প্রশিক্ষণ।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ তদারকি ও তথ্য বিনিময়- বিশেষত পরিবেশ ও নিরাপত্তা ইস্যুতে। সীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক রায় ও জাতীয় আইনকে সঙ্গত করে বাংলাদেশ সমুদ্র-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় মাইলফলক পেরিয়েছে। এখন টেকসই ব্যবস্থাপনা, আইন-প্রয়োগ, পরিবেশ রক্ষা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিত করে 'ব্লু ইকোনমি' বাস্তবায়নই প্রধান চ্যালেঞ্জ ও অগ্রাধিকার। সরকার, বিশেষজ্ঞ, নন-গভর্নমেন্টাল সেক্টর ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।


প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর