Logo

আইন ও বিচার

‘অস্ত্রধারী দেখলেই গুলি’

পুলিশের নির্দেশ আইনবহির্ভূত নাকি জরুরি প্রতিরোধ?

Icon

মাসুদ আহম্মেদ

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:১৯

পুলিশের নির্দেশ আইনবহির্ভূত নাকি জরুরি প্রতিরোধ?

চট্টগ্রামে সম্প্রতি এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা “অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী দেখলেই ব্রাশ ফায়ারের নির্দেশ” দিয়েছেন- এমন বক্তব্য সামাজিক ও আইনজীবী মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের এমন নির্দেশ কি আইনসম্মত? রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার নামে কি মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটছে? অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আইন, নীতি ও বাস্তবতার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক।

গত মঙ্গলবার দুপুরে ওয়্যারলেস সেটে সিএমপির সব সদস্যের উদ্দেশে দেয়া এক মৌখিক আদেশে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ টহল ও থানা পুলিশকে একযোগে এ নির্দেশনা দেন। যা পরবর্তীতে সিএমপি কমিশনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী-অপরাধীরা আবার চট্টগ্রামকে অন্ধকার জাহেলিয়াতের যুগে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এটা আমরা হতে দেব না। তার জন্য অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কয়েকটাকে যদি মেরে ফেলতে হয়, মেরে ফেলব; কিন্তু অন্ধকারের যুগে, জাহেলিয়াতের যুগে, চট্টগ্রামকে আর ফিরতে দেয়া হবে না। সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে চট্টগ্রাম আবার পরিণত হবে না। এটাই আমার নির্দেশ। এজন্য যা যা করণীয় আমরা সবই করব।

সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় সিএমপি কমিশনার বেতার বার্তায় নির্দেশনা দেন। যেখানে সিএমপি কমিশনার বলেছেন- ‘শটগান হবে না, চায়না রাইফেলও বাদ, এখন এসএমজি ব্রাশফায়ার মুডে থাকবে।’

বেতার বার্তায় যেকোনো পরিস্থিতি এবং নাশকতা এড়াতে টহল টিমগুলোকে এসএমজি ছাড়াও শিশা শটগান, দুটি গ্যাসগান এবং টিম ইনচার্জকে নাইন এমএম পিস্তল বহন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া স্থায়ী চেকপোস্ট ৭টি থেকে বাড়িয়ে ১৩টি করতে আদেশ দিয়েছেন কমিশনার।

বার্তায় পুলিশ সদস্যদের দণ্ডবিধি ৯৬ থেকে ১০৬ পর্যন্ত, আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার সব পুলিশ অফিসারের আছে বলে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার এবং সব দায় কমিশনার বহন করবেন বলে জানান।

আইনের দৃষ্টিতে পুলিশের গুলির নির্দেশ: বাংলাদেশে পুলিশের বলপ্রয়োগের অধিকার রয়েছে। তবে তা সীমিত ও শর্তসাপেক্ষ। পুলিশ আইন, ১৮৬১, দণ্ডবিধি, ১৮৬০, এবং দণ্ডবিধি (CrPC) ১৮৯৮-এর বিভিন্ন ধারায় পুলিশের দায়িত্ব ও ক্ষমতার সীমা নির্ধারিত আছে।

মূল আইনগত ধারা : ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC) ধারা ৪৬(২) অনুযায়ী, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে কেউ পালিয়ে গেলে বা প্রতিরোধ করলে, প্রয়োজনে “যথাযথ পরিমাণে বলপ্রয়োগ” করা যেতে পারে। তবে মৃত্যুঝুঁকি সৃষ্টি হলে বা পালানোর সময় নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা করা আইনত নিষিদ্ধ। আবার দণ্ডবিধি ৩০৪ ও ৩০২ ধারা অনুযায়ী, অযৌক্তিকভাবে কারও মৃত্যু ঘটালে তা “অবৈধ হত্যা” বা “হত্যাকাণ্ড” হিসেবে গণ্য হতে পারে।

জাতিসংঘের Basic Principles on the Use of Force and Firearms by Law Enforcement Officials (1990) -এর আলোকে বাংলাদেশও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, বলপ্রয়োগ কেবলমাত্র “ শেষ উপায়” হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

আইনবহির্ভূত নাকি জরুরি প্রতিরোধ? : “অস্ত্রধারী দেখলেই ব্রাশ ফায়ার” নির্দেশ সংবিধান ও মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী, যদি না তা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে বা তাৎক্ষণিক সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য হয়।

বাংলাদেশ সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৩২ বলছে- “কোন ব্যক্তির জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতা আইন দ্বারা ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে হরণ করা যাবে না।” অর্থাৎ, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে বিনা বিচার বা সন্দেহভাজন হিসেবে হত্যা করতে পারে না। এমনটি করলে তা “ক্রসফায়ার” বা “এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং” হিসেবে গণ্য হবে, যা আদালত একাধিক রায়ে বেআইনি ঘোষণা করেছে।

সন্ত্রাস দমন বনাম আইনের শাসন: চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধ দমন বা সন্ত্রাস প্রতিরোধে পুলিশ “ব্রাশ ফায়ার” বা “কাউন্টার অ্যাকশন” নীতি প্রয়োগ করেছে বলে অভিযোগ আছে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্র সন্ত্রাসের জবাব দিতে পারে না বেআইনি সন্ত্রাস দিয়ে।”

আইন মেনে তদন্ত, গ্রেপ্তার ও আদালতের মাধ্যমে বিচার- এই তিনটি ধাপই অপরাধ দমনের সাংবিধানিক পথ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুর রহমান এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ব্রাশ ফায়ার নির্দেশ আইনবহির্ভূত। পুলিশের দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিচার নয়। সন্দেহভাজন হলেও কেউ অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ।”

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “কখনও কখনও চরম পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালানো যুক্তিযুক্ত হতে পারে, তবে সাধারণ নির্দেশ হিসেবে ‘অস্ত্রধারী দেখলেই ফায়ার’ বলা অনৈতিক ও বেআইনি।”

ঢাকা জজ কোর্টের কয়েকজন আইনজীবী এ বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরেন। যার মধ্যে, পুলিশের বলপ্রয়োগ নীতিমালা স্পষ্টভাবে প্রণয়ন ও জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। 

সন্ত্রাস দমন অভিযানগুলোতে স্বচ্ছতা ও বডিক্যামেরা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন। আইন মন্ত্রণালয় ও মানবাধিকার কমিশন যৌথভাবে বলপ্রয়োগের সীমা নির্ধারণে নির্দেশিকা দিতে পারে। অপরাধীদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় আনা ও আদালতের রায়ে শাস্তি নিশ্চিত করাই স্থায়ী 

আইনের শাসন ব্যতিরেকে রাষ্ট্র কখনও টেকসই শান্তি বা নিরাপত্তা অর্জন করতে পারে না। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বজায় রাখতে হলে “বিচারবহির্ভূত অভিযান” নয়, বরং আইনি প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দরকার।

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর