রাজনৈতিক সহিংসতা ও জানমালের ক্ষতি করা অধিকার নয়; ফৌজদারি অপরাধ
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৩৪
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংসতা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, দোকানপাট ভাঙচুর এবং সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ ধরনের ঘটনা শুধু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নয়, বরং দেশের অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা ও আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আইনের দৃষ্টিতে এসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই রাজনৈতিক অধিকার নয়; বরং এটি ফৌজদারি অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ১৪৭ ও ১৪৮ অনুসারে দাঙ্গা ও বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে যুক্ত হলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে। আগুন লাগিয়ে স্থাপনা, যানবাহন বা দোকান ধ্বংস করলে ধারা ৪৩৫ ও ৪৩৬ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড প্রযোজ্য।
যদি এসব কার্যক্রম জনভীতি সৃষ্টি বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়, তবে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ অনুসারে তা সন্ত্রাসমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি হতে পারে আজীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড। এছাড়া অস্ত্র বা বিস্ফোরক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অস্ত্র আইন, ১৮৭৮ অনুযায়ী আলাদা সাজা প্রযোজ্য।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যদি সহিংসতা উসকে দেয়, তাহলে নেতৃত্ব পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও উসকানি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা করা যেতে পারে। আদালত চাইলে সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত বা সম্পত্তি জব্দের নির্দেশও দিতে পারে।
সমাধান কীভাবে সম্ভব? : বাংলাদেশের খবরের এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সহিংসতা দমনে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংলাপ ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। দ্রুত বিচার, প্রমাণনির্ভর তদন্ত, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা জরুরি।
একজন আইন বিশ্লেষকের ভাষায়, “রাজনীতি জনগণের সেবা করার জন্য, আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য নয়। আইন যদি সমানভাবে প্রয়োগ হয়, সহিংস রাজনীতি একদিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে।”
রাজনৈতিক বর্ধিত উত্তেজনা ও সংঘর্ষে সাধারণ জনগণের মৃত্যু, আহত, যানবাহন ও স্থাপনা পুড়িয়ে নষ্ট, এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড- এসব ঘটনা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গভীর ক্ষত তৈরি করে। আইনি ব্যবস্থা, দ্রুত তদন্ত, দায়মুক্ত রাখা যাবে না এমন কার্যকর দণ্ড-প্রক্রিয়া এবং প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেয়াই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংঘটিত সহিংসতা সাধারণত থাকে সামাজিক প্রহসন, রোড ব্লক, ভাঙচুর, অগ্নিসংশ্লিষ্ট ঘটনা (বাসা/দোকান/গাড়ি পোড়ানো), ও কখনও কখনও মর্টার/বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ভাঙচুর। এ কাজগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে (জান-মাল-স্বাস্থ্য) ও অর্থনীতিতে (ব্যবসা, ট্রান্সপোর্ট, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা) দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
বেঙ্গল পেনাল কোড (Penal Code, 1860) - ধারা 147, 148 (Rioting / Rioting armed with deadly weapon): কেউ উৎপাত/দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় হতে পারে; অস্ত্রসহ দাঙ্গায় শাস্তি বেশি কঠোর।
বেঙ্গল পেনাল কোড এর ধারা ৪৩৫/৪৩৬ : আগুন বা বিস্ফোরক ব্যবহার করে বাড়ি, যানবাহন বা অন্যান্য স্থাপনা নষ্ট করলে সাত বছরের পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা ধার্য হতে পারে- যদি মানবজানমাল বা বৃহৎ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ (Anti-Terrorism Act, 2009) : যদি কাজগুলো সামগ্রিকভাবে “সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম” বা জনভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে এই আইনের আওতায় কঠোর শাস্তি ধার্য করা যেতে পারে। আইন-প্রক্রিয়া ও সংজ্ঞা অনুযায়ী বিস্তৃত ক্ষমতা ও শাস্তি রয়েছে।
অস্ত্র আইনের বিধান (The Arms Act, 1878) অনুযায়ী লাইসেন্সবিহীন অস্ত্রধারণ, গোলাবারুদ বা বিস্ফোরক ব্যবহার করা হলে আলাদা অপরাধ হিসেবে দণ্ডনীয়। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ অনুযায়ী অগ্নি ঘটনার প্রতিরোধ, সতর্কতা ও জরুরি সেবা-সংক্রান্ত বিধান; অগ্নিকাণ্ড ঘটলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকার কার্যক্রম সংজ্ঞায়িত।
যারা সরাসরি আগুন জ্বালায়, ভাঙচুর করে বা সন্ত্রাসী কাজ করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা (পুলিশে অভিযোগ, গ্রেফতার, দায়ের মামলা) চলে এবং বিচারের মাধ্যমে দণ্ড দেয়া হয়।
কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী, সংগঠন বা অর্গানাইজড গ্রুপ যদি পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা সংগঠিত করে, তাহলে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যোগসাজশ, উসকানি বা সহায়তার ভিত্তিতে দায়ী ধরা হতে পারে; পুঁজিবাদী শক্তিকে আইনি প্রক্রিয়ায় আসামি করা যায়। ((Penal Code ধারাগুলি ও Anti-Terrorism Act প্রযোজ্য হতে পারে)।
পুলিশ বা প্রশাসন যদি অবহেলা করে বা জবাবদিহি এড়ায় তবে তদুপরি প্রশাসনিক তদন্ত, যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া চালু করা দরকার। সরকারের দায়ও প্রসঙ্গে বিচার বিভাগীয় তদারকি বা মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধান প্রয়োজন হতে পারে। ফৌজদারি ঘটনায় দায়ী শনাক্ত করতে ফরেনসিক (সিসিটিভি, মোবাইল ডাটা, ফায়ার ম্যাচিং), প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য ও ডিএনএ প্রয়োজন। প্রমাণ সুরক্ষা ও সাক্ষী সুরক্ষা- প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে তারা বিচারে সাহসিকতার সাথে সাক্ষ্য দিতে পারে।
রুটিন বিজিল্যান্স ও তথ্যভিত্তিক তদন্ত যেমন গোয়েন্দা তথ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যেম মনিটরিং ও লাইভ-ট্র্যাকিং কাজে লাগানো জরুরি।
দণ্ড ও শাস্তি যদি কেউ গাড়ি/বাড়ি/দোকান পুড়িয়ে দেয়: Penal Code ধারা ৪৩৫/৪৩৬ অনুযায়ী কারাদণ্ড (সর্বোচ্চ ৭ বছর) ও জরিমানা। যদি সন্ত্রাসী উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয় (জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি): Anti-Terrorism Act অনুযায়ী কঠোর শাস্তি ও আর্থিক দণ্ড, সম্ভাব্য জীবন কারাদণ্ড/মৃত্যুদণ্ড (আইন ও মামলার ধরন অনুযায়ী)। অস্ত্র ব্যবহার বা অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ড হলে Arms Act অনুযায়ী শাস্তি ও লাইসেন্স বাতিল হবে।
বিকেপি/এনএ

