জেলখানা থেকে আদালতে হাজিরা
আসামির পালানোর যৌক্তিক শঙ্কা থাকলে হাতকড়া ব্যবহার
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৪৫
বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় জেলখানায় থাকা আসামিদের আদালতে হাজিরা দেয়া একটি নিয়মিত ও আইনসম্মত প্রক্রিয়া। আদালত যেসব মামলার শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে, সেসব তারিখে সংশ্লিষ্ট আসামিদের জেলখানা থেকে আদালতে উপস্থিত করা হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিরাপত্তা, যানবাহনের সংকট, হাজতখানার জনবল ঘাটতি ও ডিজিটাল হাজিরা (video conference) নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
ফৌজদারী কার্যবিধি (Criminal Procedure Code, 1898) অনুযায়ী ধারা ৩৪৪ ও ৩৪৫ তে বলা হয়েছে আদালত প্রয়োজনে আসামিকে হাজির করতে বা হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। ৩৪০ ধারায় আসামির শারীরিক উপস্থিতি বাধ্যতামূলক, যদি না আদালত ভিডিও কনফারেন্স বা মেডিকেল কারণে ব্যতিক্রম দেন।
৫৪ ও ১৬৭ ধারা অনুযায়ী পুলিশ বা জেল কর্তৃপক্ষ আদালতের অনুমতি ছাড়া আসামিকে হাজির করতে পারে না; আদালতের রিমান্ড আদেশ বা প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট প্রয়োজন হয়। এছাড়া কারা আইন, ১৮৯৪ (The Prisons Act, 1894) এর ধারা ৪০ এ বলা হয়েছে, আদালতের নির্দেশ ব্যতীত কোনো বন্দিকে কারাগার থেকে বাইরে নেওয়া যাবে না। ৪৫-৪৬ ধারায় আসামি পরিবহনের সময় নিরাপত্তা বিধান, শৃঙ্খলা রক্ষা ও পালানোর ঝুঁকি প্রতিরোধে নির্দেশনা রয়েছে। জেল কোড (Bangladesh Jail Code, 2006) অনুযায়ী Rule 510-518 : আদালতে হাজিরার আগে বন্দির স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পোশাক ও পরিবহন সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জঁষব ৫২৩ : মহিলা বন্দিদের ক্ষেত্রে নারী পুলিশ বা সশস্ত্র রক্ষী থাকতে হবে। ৫২৬ রুলে হাজিরার সময় হাতকড়া বা দড়ি ব্যবহার আদালতের অনুমতি ও পরিস্থিতি অনুযায়ী হতে পারে।
উচ্চ আদালতের রায়সমূহ : বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (BLAST) বনাম সরকার, ২০১৬ : আদালত নির্দেশ দেয় “হাতকড়া ব্যবহার হবে কেবলমাত্র পালানোর যুক্তিসঙ্গত আশঙ্কা থাকলে।” -High Court Division (Writ No. 6354/2018): ভার্চুয়াল হাজিরা বা ভিডিও কনফারেন্সে হাজিরার নির্দেশ দেওয়া যায় যদি নিরাপত্তা ও জনস্বার্থে তা উপযুক্ত মনে হয়। Supreme Court Circular, 2020 (COVID সময়): অনলাইন আদালত ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাজিরা বৈধ এবং তা Code of Criminal Procedure-এর ধারা ৫৪ই অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য।
নিরাপত্তা ও মানবাধিকার ইস্যু : বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন (NHRC)-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- “প্রায় ১৮% ক্ষেত্রে আদালতে হাজিরার সময় নিরাপত্তা ঝুঁকি ও মানহানিকর আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।” তাছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাজিরা বিলম্বে নেয়ার কারণে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়, যা Article ৩৫(৩) অনুযায়ী “বিচারের অধিকার লঙ্ঘন” হিসেবে গণ্য হতে পারে।
ডিজিটাল হাজিরা : ২০২১ সালে চালু হওয়া Virtual Court Act, ২০২০ অনুযায়ী আদালত চাইলে আসামিকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাজির করতে পারে। ২০২৫ সালের হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় ৬৮টি জেলা কারাগার থেকে ৯০% মামলার প্রাথমিক হাজিরা এখন অনলাইনে সম্পন্ন হয়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত উপাত্ত ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট জেলখানার সংখ্যা ৬৮, মোট বন্দির সংখ্যা প্রায় ৯০,০০০ হাজিরার জন্য আদালতে গমন দৈনিক গড়ে ১,৮০০ বন্দি, ভিডিও কনফারেন্সে হাজিরা প্রায় ৬০-৬৫% মামলা আর নিরাপত্তাজনিত ঘটনা বছরে গড়ে ১২-১৫টি (Prison Directorat Report, 2024) জেলখানা থেকে আসামিদের আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা নমস্যা। এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো-পরিবহন ঘাটতি ও জনবল সংকট, হাজত পুলিশের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব, আদালত কক্ষের নিরাপত্তা দুর্বলতা, ভিডিও হাজিরা প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং বন্দিদের মানবিক আচরণ ও মানসিক চাপ এ সব সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ নেয়া যায় এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নরসিংদী জেলা জজ আদালতে সিনিয়র আইনজীবী শরিফুল ইসলাম চৌধুরী দর্পণ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এ ক্ষেত্রে আদালত ও জেল প্রশাসনের মধ্যে রিয়েল টাইম সমন্বয় ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
ভিডিও হাজিরার জন্য নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি ব্যবহার। বন্দিদের স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার নিশ্চিতে জেল কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ।
কারারক্ষীদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম বৃদ্ধি করা এবং হাজিরা প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য ঈঈঞঠ ও ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
দেশে আদালতে হাজিরা প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক ধাপ, যা ন্যায়বিচারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে। তবে মানবাধিকার, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত দিকগুলো আরো শক্তিশালী করা দরকার। স্বচ্ছতা ও মানবিকতার সমন্বয়ে এই প্রক্রিয়াকে আধুনিকায়ন করা গেলে বিচার ব্যবস্থা আরো কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত হবে।
বিকেপি/এমবি

