আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কূটনৈতিক সেতুবন্ধ
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২৭
চলতি বছরের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। রাজধানী ঢাকায় বিদেশি দূতাবাসগুলোর সম্প্রসারণ ঘটেছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে। একইসঙ্গে বাংলাদেশও প্রায় ৬০টির বেশি দেশে নিজস্ব দূতাবাস পরিচালনা করছে।
কূটনৈতিক মহল বলছে- ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় দূতাবাসগুলোর ভূমিকা আজ আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে কূটনৈতিক ইমিউনিটির অপব্যবহার রোধে নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত Vienna Convention on Diplomatic Relations, 1961- অনুযায়ী অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। এই আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইন অনুযায়ীই বিদেশি দূতাবাস স্থাপন, রাষ্ট্রদূত নিয়োগ এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশে অন্য রাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপন করা হয় প্রধানত ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস, ১৯৬১ (Vienna Convention on Diplomatic Relations, 1961), Bangladesh Diplomatic and Consular Privileges Act, 1982, এবং সংবিধানের ২৫(১) অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ সকল জাতির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আন্তর্জাতিক সৌহার্দ্য বজায় রাখবে।
এই আইনগুলোর আলোকে বিদেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমতি নিয়ে রাজধানী ঢাকায় বা নির্দিষ্ট স্থানে দূতাবাস স্থাপন করতে পারে। সাধারণত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে “নোট ভারবাল (Note Verbale)” বিনিময় হয়।
দূতাবাস মূলত কোনো রাষ্ট্রের সরকার ও নাগরিকদের অন্য রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্ব করে। এর প্রধান কাজ হলো- দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করা, নাগরিকদের ভিসা, পাসপোর্ট ও কনস্যুলার সেবা প্রদান, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহযোগিতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তায় সমন্বয়, দুই দেশের সরকারের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ রক্ষা করা। ঢাকায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সৌদি আরবসহ ৭০টিরও বেশি দেশের দূতাবাস ও উচ্চ কমিশন কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক কর্মীদের জন্য বিশেষ ইমিউনিটি ও প্রিভিলেজ নির্ধারিত রয়েছে। সেগুলো হলোকূটনৈতিক নিরাপত্তা ও রক্ষা- রাষ্ট্রদূতের ব্যক্তিগত ও সরকারি বাসভবনে অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না। আদালতের বিচার থেকে মুক্তি- রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাস কর্মীরা বাংলাদেশে অবস্থানকালে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হতে পারেন না (যদি না নিজ দেশ তাদের ইমিউনিটি প্রত্যাহার করে)। কর ও শুল্কমুক্ত সুবিধা- তাদের আমদানিকৃত অফিস সরঞ্জাম, যানবাহন ও ব্যক্তিগত পণ্যের ওপর কর আরোপ করা যায় না। আবাসন ও যোগাযোগের স্বাধীনতা- তারা স্বাধীনভাবে অফিস পরিচালনা, যোগাযোগ ও বৈঠক করতে পারেন। রাষ্ট্রীয় সম্মান ও নিরাপত্তা-বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য।
কূটনৈতিক সুবিধা ভোগের পাশাপাশি রাষ্ট্রদূতদের কিছু মৌলিক দায়িত্বও রয়েছে। আতিথেয় রাষ্ট্রের আইন, প্রথা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করা, দূতাবাসকে বিদেশি প্রচারণা বা রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার না করা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্য বজায় রেখে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব।
আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে করণীয় : যদি কোনো কূটনীতিক বাংলাদেশের আইন ভঙ্গ করেন, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় Vienna Convention-এর ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে তাকে persona non grata ঘোষণা করতে পারে, অর্থাৎ তাকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়া বা বহিষ্কার করা যায়। অতীতে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশ এই বিধান প্রয়োগ করেছে।
বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাস স্থাপন ও রাষ্ট্রদূতদের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন, সার্বভৌম সম্মান ও কূটনৈতিক নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়।
দূতাবাস শুধু রাজনৈতিক সম্পর্ক নয়- বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও মানবিক সহযোগিতারও এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তাই এই কূটনৈতিক কাঠামো যেন আইনের সীমার মধ্যে থেকে রাষ্ট্রের মর্যাদা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে, সেটিই সময়ের দাবি।
বিকেপি/এমবি

