সাইবার নিরাপত্তা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব : সচেতনতা, প্রতিরোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব
মো. আবদুর রহমান মিঞা
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২৬
ডিজিটাল যুগে মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ক্রমশ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। আজ মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা ই-গভর্নেন্স- সবকিছুই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রযুক্তির এই দ্রুত অগ্রগতি আধুনিক বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নামে পরিচিত হয়েছে। তবে এই উন্নয়ন যেমন আমাদের সামনে অগণিত সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে, তেমনি নতুন ধরনের ঝুঁকি, বিশেষ করে সাইবার অপরাধের ভয়াবহ বিস্তার ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই হুমকি দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা- ফেসবুক মেসেজ, ভুয়া লিংক, কল সেন্টারভিত্তিক প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিং হ্যাক, ডিপফেক ভয়েস কল কিংবা ইলেকট্রনিক আর্থিক লেনদেনভিত্তিক অপরাধ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতারকরা মানুষের সরল বিশ্বাস, ভয়, লোভ এবং প্রযুক্তিগত অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সংগঠিতভাবে অপরাধ পরিচালনা করছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত সচেতনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় নীতি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
ডিজিটাল রূপান্তরের ফলে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিক এখন মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আর্থিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। কিন্তু এই সুবিধার সঙ্গে ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ ব্যবহারকারীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা সীমিত হওয়ায় সাইবার অপরাধীরা সহজেই সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে বিকাশ বা রকেট অ্যাপ, জাতীয় পরিচয়পত্রভিত্তিক পরিচয় যাচাই ব্যবস্থা, অনলাইন আর্থিক পোর্টাল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সব জায়গাতেই প্রতারণার আশঙ্কা রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা এখন আর কেবল প্রযুক্তিগত বিষয় নয়; এটি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতি, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।
সাইবার অপরাধীরা সাধারণত মানুষের মনস্তত্ত্বের চারটি দুর্বলতা ব্যবহার করে ভয়, লোভ, আস্থা এবং তাড়াহুড়া। তারা ভয় দেখায়, যেমন “আপনার সিম বন্ধ হয়ে যাবে” বা “আপনার অ্যাকাউন্ট ব্লক হয়ে গেছে”; আবার লোভ জাগায় “আপনি লটারি জিতেছেন” বা “বিশেষ অফার পাচ্ছেন”। কখনো তারা সরকারি কর্মচারী, ব্যাংক কর্মকর্তা কিংবা এনআইডি অফিসের প্রতিনিধি সেজে বিশ্বাস অর্জন করে এবং তাড়াহুড়ার মধ্যে মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। এভাবে মানুষ নিজের অজান্তেই প্রতারকের ফাঁদে পড়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ ওটিপি (OTP) বা পিন (PIN) কারও সঙ্গে শেয়ার না করলেও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। প্রতারকরা শুধু প্রযুক্তি নয়, মানুষের আচরণ ও নেটওয়ার্ক সিস্টেমের দুর্বলতাকেও কাজে লাগিয়ে এমন অনধিকার লেনদেন সম্পন্ন করে।
প্রযুক্তিগতভাবে এ ধরনের অপরাধ ঘটে ঝওগ ংধিঢ়, ফোন ক্লোনিং, রিমোট অ্যাক্সেস, সামাজিক প্রকৌশল বা ভুয়া অ্যাকাউন্ট রিসেট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রতারকরা প্রায়ই অহুউবংশ বা ঞবধসঠরববিৎ-এর মতো অ্যাপ ইনস্টল করতে বলে, যার মাধ্যমে তারা ভুক্তভোগীর ফোন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়। কেউ যদি ভয় বা অজ্ঞতার কারণে অনুমতি দেয়, তবে ব্যাংকিং অ্যাপ, মেসেজ, এমনকি পাসওয়ার্ডও প্রতারকের হাতে চলে যায়। তাই সাইবার নিরাপত্তা রক্ষায় সচেতনতা ও আচরণগত সতর্কতা সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক বা সার্ভিস প্রোভাইডারের অফিসিয়াল নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ জানাতে হবে।
সাইবার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, ব্যাংকার এমনকি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞও। সাধারণ ভুলগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিচিত নম্বরে ফোন রিসিভ করা, অজানা লিংকে ক্লিক করা, ফেসবুকে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা, পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করা, দুর্বল পাসওয়ার্ড রাখা ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিটিই প্রতারকদের জন্য সুযোগ তৈরি করে। অনেকে আবার একাধিক অ্যাকাউন্টে একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন, ফলে একটি ভাঙলে বাকি সবও ঝুঁকিতে পড়ে। এই অসাবধানতা দূর না হলে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা কোনো কাজে আসে না।
বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ এখন এক সংগঠিত অপরাধচক্রের রূপ নিয়েছে। একদল তথ্য সংগ্রহ করে, আরেকদল ভয়েস ম্যানিপুলেশন করে, তৃতীয় দল প্রযুক্তিগতভাবে আক্রমণ চালায় এবং শেষ দল টাকা উত্তোলন করে। এর ফলে ব্যক্তিগত ক্ষতির পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও ডিজিটাল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও হুমকির মুখে পড়ে। প্রতারকরা এখন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত, যারা ফিশিং সার্ভার পরিচালনা করে, ভয়েস আইপি কল ব্যবহার করে এবং কালোবাজারে ব্যাংকিং তথ্য বিক্রি করে। সুতরাং এটি আর ছোট সমস্যা নয়; বরং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বৃহৎ ইস্যু।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তার সম্পর্ক সরাসরি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এর ভিত্তি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লকচেইন ও ক্লাউড কম্পিউটিং। এই সব প্রযুক্তি যত বেশি ব্যবহৃত হবে, ততই সাইবার ঝুঁকি বাড়বে। এখনকার যুদ্ধ আর বন্দুক বা কামানের নয়, বরং ডেটা, নেটওয়ার্ক ও পরিচয়ের ওপর। ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য, শিল্প, অবকাঠামো—সবই যখন ডিজিটাল নেটওয়ার্কে নির্ভরশীল, তখন সাইবার আক্রমণ পুরো ব্যবস্থাকেই পঙ্গু করে দিতে পারে। তাই ৪ওজ সফল করতে হলে প্রযুক্তিগত দক্ষতার পাশাপাশি নিরাপত্তা দক্ষতাও অপরিহার্য।
বাংলাদেশ সরকার সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে নানা আইন ও কাঠামো গঠন করেছে। ২০২৫ সালের সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, পূর্ববর্তী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এসবের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনাল, সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিট, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং ইএউ ব-এড়া ঈওজঞ জাতীয় পর্যায়ে কাজ করছে।
জরুরি সেবা ৯৯৯ কিংবা বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের হেল্পলাইনও জনগণকে সহায়তা দিচ্ছে। তবে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে অপরাধীদের কৌশল দ্রুত পরিবর্তন হয়, ফরেনসিক দক্ষতা সীমিত, ডেটা সমন্বয় দুর্বল, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজনীয় মাত্রায় নেই। তাই কেবল আইন থাকলেই চলবে না; তার কার্যকর প্রয়োগ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন), বেপজা, ঢাকা
বিকেপি/এমবি

