সারা দেশে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তথাকথিত অলৌকিক রত্নপাথর, ম্যাজিক আংটি ব্যবসায়ী প্রতারকচক্র। রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনা সব বড় শহরেই একধরনের একই ধাঁচের দোকান দেখা যাচ্ছে।
চটকদার রঙিন ব্যানার, LED বোর্ড এবং অলৌকিক শক্তির দাবি সব মিলিয়ে যেন ‘সাফল্যের গ্যারান্টি’ বিক্রি করছে একদল প্রতারক। দোকানের সামনে বড় করে লেখা ‘মাত্র ৭ দিনে ব্যবসা জমে উঠবে!’ ‘মহাজাগতিক শক্তির আংটি পরলে ভাগ্য খুলবে!’ ‘ভি-ক্রিম: ডাক্তার জ্যোতিষ-বিজ্ঞান সম্মত!’
কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে- লাখ লাখ টাকার প্রতারণা, আর ভুক্তভোগীদের আর্তচিৎকার। বাংলাদেশের ব্যস্ত মার্কেটগুলোতে সহজেই চোখে পড়ে এসব দোকানের ব্যানার। সাধারণত অভিজাত বাজার বা ব্যস্ত সড়কসংলগ্ন দোকানে রঙিন লাইটে সাজানো কাচের শোকেস। ভেতরে নানান রঙের পাথর, আংটি কিংবা ভি-ক্রিমের ডিবা।
দোকানের ভেতরে বসে থাকে নিজস্ব ‘জ্যোতিষ বিশেষজ্ঞ’ বা ‘অ্যাডভাইজার’ যাদের কাজ একটাই: গ্রাহককে ভয় দেখানো। কখনও বলা হয়- ‘আপনার ঘর অশুভ শক্তিতে আক্রান্ত’, ‘গ্রহদোষ আছে’, ‘ব্যবসায় পাঁচ বছর ধরে লোকসান- এই আংটি না নিলে আরও ক্ষতি হবে’। মানসিকভাবে প্রভাবিত করার পর শুরু হয় মূল ফাঁদ।
২০০ টাকার নকল পাথর বিক্রি হয় ৫০,০০০-১,৫০,০০০ টাকায়। আর ৫০-১০০ টাকার ভি-ক্রিম বিক্রি হয় ‘বিশেষ এনার্জি ক্রিম’ নামে ১০,০০০ টাকায়। ধনী পরিবারের ওপর বিশেষ টার্গেট- প্রতারকচক্রের লক্ষ্য সাধারণ মানুষ নয়, বেশি টাকা আছে এমন পরিবার। রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান এলাকায় দোকানের কর্মচারীরাই এমটিই স্বীকার করেছে।
অপরাধীরা জানে অনেক ভুক্তভোগী প্রতারণার কথা প্রকাশ করতে লজ্জা পান। ফলে প্রতারণা চক্র আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘তারা বলল, আমার পরিবারের ওপর অশুভ দৃষ্টি। পাথর কিনলে নাকি উন্নতি হবে। ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিলাম। আংটি পরে কিছুই হয়নি। পরে বুঝলাম আমি প্রতারিত।’
চট্টগ্রামের এক কলেজ শিক্ষক বলেন, ‘ভি-ক্রিম ব্যবহারের পর মুখ জ্বালা শুরু হয়। দোকানদারকে ফোন দিলে নম্বর বন্ধ।’ আইন কঠোর, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল: বাংলাদেশে ভুয়া বিজ্ঞাপন ও প্রতারণা দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রযোজ্য আইন- দণ্ডবিধি ৪১৫- ৪২০: প্রতারণা (সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড) ৪৬৮-৪৭১: জাল কাগজপত্র ভোক্তা অধিকার আইন, ২০০৯: ভুয়া বিজ্ঞাপন, প্রতারণামূলক বিক্রয়, ইঝঞও আইন অনুমোদন ছাড়া প্রসাধনী বিক্রি।
সাইবার ক্রাইম আইন: বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন।
তবে বাস্তব সমস্যা হলো প্রতারণার শিকাররা অভিযোগ করতে চান না, আর প্রশাসন নিয়মিত তদারকি করে না।
ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেরশের খবরকে বলেন, ‘আমরা অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু দোকানগুলো দ্রুত স্থান বদলে ফেলে। কিছু দোকান ভিন্ন নামে আবার খুলে যায়।’
কেন প্রশাসনের পক্ষে ধরতে কঠিন? : দোকানগুলো ভিন্ন নামে রেজিস্ট্রেশন করে, দ্রুত দোকান স্থানান্তর করে, লাইসেন্স ছাড়া পণ্য বিক্রি করে, অনলাইনে ভুয়া বিজ্ঞাপন ছড়ায়, ভুক্তভোগীরা নীরব থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যতদিন না ভোক্তারা অভিযোগ করবেন, ততদিন এ চক্র ভাঙা কঠিন। সমাজে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে।
এই প্রতারণা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয় অর্থনৈতিক ক্ষতি, কুসংস্কার বৃদ্ধি, মানসিক শোষণ, পরিবারে অশান্তি. হতাশা ও অবিশ্বাস তৈরি, শিক্ষিত সমাজেও অন্ধবিশ্বাস ছড়ানো। এদিকে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানীরা একে ‘মাইন্ড-ম্যানিপুলেশন বিজনেস’ বলে অভিহিত করেছেন।
কীভাবে বাঁচবেন প্রতারণা থেকে :‘ভাগ্য বদলের আংটি/পাথর’ বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন। কোনো পণ্য কিনলে BSTI সনদ আছে কি না নিশ্চিত হতে হবে। অলৌকিক দাবি করা দোকানগুলো আসলে উচ্চমানের প্রতারণা কেন্দ্র প্রতারণা হলে দ্রুত অভিযোগ করুন ভোক্তা অধিদপ্তরে ১৬১২১ টোল ফ্রি নম্বরে।
থানায় প্রতারণা মামলা, সাইবার ইউনিটে অভিযোগ এবং পরিবারের সদস্য কেউ এসব বিশ্বাসে জড়িয়ে পড়লে তাকে সচেতন করুন। বাংলাদেশে “ম্যাজিক-পাথর” প্রতারণা এখন সংগঠিত শিল্পে পরিণত হয়েছে। দোকানগুলো চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের আবেগকে লক্ষ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
প্রশাসন চাইলেই অভিযান চালাতে পারে, আইনও আছে কিন্তু প্রয়োজন ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আর প্রয়োজন সমাজকে কুসংস্কার থেকে দূরে রাখা। অলৌকিক শক্তির আংটি নয়- সচেতনতা ও আইনই পারে প্রতারণা রোধ করতে।
বিকেপি/এনএ

