Logo

আইন ও বিচার

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বিদেশ থেকে ফেরত আনার পদ্ধতি

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৩০

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বিদেশ থেকে ফেরত আনার পদ্ধতি

প্রতীকী ছবি

বিদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত/মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশের নাগরিককে ফিরিয়ে আনা (repatriation ev transfer) করার ক্ষেত্রে দুটি আলাদা প্রক্রিয়া থাকতে পারে। এক্সট্রাডিশন (extradition)- যেখানে অভিযুক্তকে বিচারের বা সাজা কার্যকর করার জন্য অপরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে সরাসরি তুলে নেওয়া হয়; এবং ট্রান্সফার অব সেনটেন্সড পারসনস / রেপেট্রিশন অফ প্রিজনারস- যেখানে বিদেশে সাজা কার্যকর হচ্ছে এমন ব্যক্তিকে তার নিজ দেশে সাজা ভোগ করতে আনতে বলা হয় বা অনুরোধ করা হয়।  

প্রাসঙ্গিক আইনগত কাঠামো : বাংলাদেশের এক্সট্রাডিশন আইন- বাংলাদেশে fugitives (পলাতক অপরাধী) উদ্ধারের এবং বিদেশি প্রত্যর্পণের জন্য প্রধান আইন হলো The Extradition Act, 1974 যা প্রত্যর্পণ-অনুরোধ গ্রহণ, শুনানি এবং সশরীরে হস্তান্তরের নিয়ম নির্ধারণ করে। (আদালত-নির্ধারিত শর্তাদি ও অপরাধ-যোগ্যতার বিধান আছে)। দেশান্তর/Transfer of Sentenced Persons (আন্তর্জাতিক কনভেনশন): ১৯৮৩ সালে শিল্পিত Convention on the Transfer of Sentenced Persons (ETS No.112) আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় যার মাধ্যমে একটি চুক্তি- দেশের নাগরিককে নিজের দেশে এনে সাজা ভোগ করতে দেওয়া যায়; কনভেনশনে ট্রান্সফারের শর্ত, অনুমতি, রাষ্ট্রীয় যাচাইকরণ ও ক্ষমা/কমিউটেশন ইত্যাদির বিষয় রয়েছে। বহু দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক/বহুপাক্ষিক সমঝোতা এ রকম ট্রান্সফার সহজ করে।

কনসুলার অধিকার (Vienna Convention on Consular Relations, 1963: বিদেশে আটক বা সাজাপ্রাপ্ত কোনো নাগরিককে কনসুলার নোটিফিকেশন ও অ্যাক্সেসের অধিকার আছে; এটি প্রাথমিকভাবে নাগরিকের কনসুলকে জানানোর দায়িত্ব আর তাদের কনসুলার সহায়তা নিশ্চিত করে ফলে কনসুল কোর্ট, আইনজীবী নিয়োগ, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদিতে সাহায্য করতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড (UN/ICCPR I UN safeguards): মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও UN-এর “Safeguards Guaranteeing Protection of the Rights of Those Facing the Death Penalty” প্রযোজ্য; এসব কাঠামো দাবি করে যে মৃত্যুদণ্ড কেবল ‘সবচেয়ে গুরুতর অপরাধে’ প্রযোজ্য এবং প্যারাডাইম- মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে নির্দিষ্ট সুযোগ (appeal, clemency) থাকতে হবে। রাষ্ট্রগুলোকে প্রত্যর্পণ/ট্রান্সফার বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা লক্ষ রাখতে হবে। 

বাস্তব ধারা-যেসব পথে ফেরত আনা যায়-
বিনিময় শর্তে প্রত্যর্পণ (Extradition) : যদি অপরাষ্ট্রে পালানো/আশ্রয়প্রাপ্ত একজনকে বাংলাদেশে এনে বিচার/দণ্ড কার্যকর করতে চান এবং সেই দেশের সাথে প্রত্যর্পণ চুক্তি বা আইনগত প্রক্রিয়া আছে- সরকার অনুরোধ জানায়; প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে সেখানকার আদালত দাবি ও উপস্থাপন যাচাই করে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনো কোনো  অপরাধে (death-penalty-যাচক অপরাধসহ) প্রত্যর্পণ সম্ভব, তবে কিছু পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড পুরোদমে কার্যকর করার আগে অনুরোধকারী রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা (assurance) দিতে হতে পারে। আদেশ/চুক্তির ভিত্তিতে: যদি বিদেশে কেউ ইতিমধ্যে দণ্ডিত হয়ে থাকে (sentenced) এবং তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হন, বাংলাদেশ সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/পরিবার ট্রান্সফার অনুরোধ করতে পারে।  ট্রান্সফার প্রক্রিয়ায় মূলত সেই দেশের সম্মতি, আদালত/প্রশাসনিক অনুমতি এবং বাংলাদেশে গ্রহণের শর্ত সম্পন্ন হয়। ETS No.112 এ স্টেটগুলোকে একে অপরকে সর্বাধিক সহযোগিতা প্রদানে উৎসাহিত করে এবং ট্রান্সফার পেলে হস্তান্তরকারী রাষ্ট্র যে অংশটুকু দেশে রেখে যায় (অর্থাৎ ক্ষমা বা কমিউটেশনের ক্ষমতা) সে বিষয়ের প্রতিরোধ বা স্বীকৃতি কাব্য আছে।

ডিপ্লোম্যাটিক/রাজনৈতিক উদ্যোগ ও কনসুলার কর্ম : অনেক কেসে সরকার-স্তরের কূটনৈতিক চিঠি, নোটস, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দ্রুততা আনার চেষ্টা করা হয়। কনসুল নাগরিককে আইনি সহায়তা, স্থানীয় আদান-প্রদান, এবং অনেকে করোনভুক্ত বা মানবিক কারণে জটিলতার সমাধান করতে পারে। ভিসা- বা ইমিগ্রেশন-সংক্রান্ত বিষয় বিবেচনা করে, কখনও কখনও বিশেষ কূটনৈতিক বন্দোবস্তও প্রয়োজন হতে পারে। 

প্রয়োগযোগ্য ধাপ-
প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ ও কনসুলার অ্যাকশন : বিদেশে অবস্থানরত আসামির বর্তমান আইনি অবস্থা (arrested / charged / convicted / sentenced) স্পষ্ট করে নিন। অবিলম্বে স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশনকে জানানো ও কনসুলার নোটিফিকেশন দাবি করুন (Vienna Convention, Article 36 অনুসারে)। কনসুলার নোটিফিকেশন প্রমাণগুলোর অনুলিপি সংগ্রহ করুন।

খ) আইনি পথ নির্ধারণ : যদি convicted and sentenced হন  Transfer of Sentenced Persons রুট খতিয়ে দেখুন: কোনো-দেশের চুক্তি আছে কি না; দ্বিপাক্ষিক প্রোটোকল/চুক্তি আছে কি না। প্রয়োজনে মানবিক কারণে অনুরোধ করা যায়। যদি charged/accused অবস্থায় পলাতক থাকেন- 

extradition পথ গ্রহণ করতে হবে; রিমান্ড এবং সাক্ষ্যাদির প্রমাণাদি বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী প্রস্তুত। গতানুগতিকভাবে আন্তর্জাতিক নোটিশ, MLAT (mutual legal assistance) অনুরোধ ও আদালত-শুনানি প্রয়োজন হবে।

মৃত্যুদণ্ড বিশেষ বিবেচনা : যদি অপরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন প্রত্যর্পণ/ট্রান্সফারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো প্রায়ই ডিপ্লোম্যাটিক আশ্বাস (diplomatic assurances) দাবি করে-মানে: “এই ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না / মৃত্যুদণ্ড সম্পাদিত হবে না” ইত্যাদি। তবে মানবাধিকার সংস্থা ও কিছু বিচারব্যবস্থা এই আশ্বাসকে যথেষ্ট নিরাপত্তা মনে করে না কারণ আশ্বাস লঙ্ঘিত হলে অনুসরণ করা কঠিন। 

অতএব, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও ব্যক্তির মানবাধিকার বিবেচনা করে আবেদনকারীর আইনজীবী ও সরকারকে যৌক্তিক ও শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি সংগ্রহ করতে হবে। আদালত ও প্রশাসনিক অংশ : প্রত্যর্পণ-অনুরোধ পেলে সেখানকার আদালত নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করে (provisional arrest  hearing decision)। ট্রান্সফার আবেদন হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (কারাগার/কোর্ট) কর্তৃক শর্তসাপেক্ষে হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরের পূর্বে dockets, sentence papers, medical reports ইত্যাদি যাচাই করা হয়।

শেষ ধাপ
পরিবহন ও গ্রহণ : হস্তান্তর সিদ্ধান্ত হলে আনুষ্ঠানিক নোট, কনসুলার উপস্থিতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বিমানের/মুক্তিযুদ্ধের লগিস্টিক্স সমন্বয় করে ব্যক্তিকে দেশে আনা হয়; দেশে পৌঁছানোর পর আদালত/জেল কর্তৃপক্ষ সেই অনুযায়ী নিয়ম মেনে সাজা কার্যকর করবেন বা স্থানীয় আইনে প্রযোজ্য রিভিউ/কমিউটেশন শুরু হবে। 

সমস্যাযুক্ত ক্ষেত্র ও ঝুঁকি : রাজনৈতিক মামলা ও নিরাপত্তা-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে থাকা ফিলিংগুলোতে প্রত্যর্পণ অনুরোধকে কোনো দেশের বিচার-নিরপেক্ষতা বিবেচনায় বন্ধ/বিলম্ব করা হতে পারে।

ডিপ্লোম্যাটিক আশ্বাসের বিশ্বাসযোগ্যতা : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি প্রায়শই আশ্বাসকে অবিশ্বাস করে তাই সংবাদে “কোন ধরনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে” তা স্পষ্ট করে তুলুন (লিখিত, আইনি গ্র্যান্ত, আদালত-নিরীক্ষণসহ)। মানবাধিকার বাধ্যবাধকতা: কিছু দেশ যেখানে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ বা moratorium আছে, তারা মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য দেশে কাউকে ফিরিয়ে নেবে না বা বিশেষ শর্তে নেবে-এইসব কূটনৈতিক/আইনগত জটিলতা বিবেচ্য। 

সুপারিশ (সরকার/আইনজীবী/পরিবারের জন্য) : দ্রুত কনসুলার নোটিফিকেশন নিশ্চিত করুন ও স্থানীয় আইনজীবী নিয়োগ করুন। যদি ট্রান্সফার চান-ETS112 বা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে কি না তা যাচাই করুন এবং আনুষ্ঠানিক আবেদন দ্রুত পাঠান। মৃত্যুদণ্ড জটিল কেসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষণ/মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করুন; রাজনীতিকভাবে নাজুক কেসে কূটনৈতিক চ্যানেল শক্ত রাখুন।

বিদেশ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত/দণ্ডপ্রাপ্ত একজন নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ আইনগতভাবে সংযুক্ত, কূটনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এবং মানবাধিকারগতভাবে সংবেদনশীল। প্রত্যর্পণ ও ট্রান্সফারের পৃথক আইনি রুট থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে উভয় ক্ষেত্রেই কনসুলার সহায়তা, শক্তিশালী প্রমাণসংগ্রহ, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, এবং প্রয়োজনে কূটনৈতিক আশ্বাসের ব্যবহার জরুরি।

বিকেপি/এমএইচএস 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর