Logo

আইন ও বিচার

বাড়ছে প্রতারণা ও মামলার জট

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৩

বাড়ছে প্রতারণা ও মামলার জট

বাংলাদেশে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাজারের আঙ্কেলরা পর্যন্ত বিকাশে টাকা নেন, রিকশা-চালকরাও গুগল ম্যাপ দেখে শর্টকাট ধরেন, আর জমিদারের বংশধররা ফেসবুকে লাইভে এসে জমিদারি দাবি করেন। শুধু বিয়ে-তালাকের রেজিস্ট্রেশনই রয়ে গেছে যেন আগেকার আমলের ‘হাতের লেখার খাতা’, যেটা দেখলে মনে হয়- এটা বুঝি আমাদের ইতিহাসের শেষ প্রত্নতাত্ত্বিক অবশিষ্ট।

আর সত্যি বলতে কী, বিয়ে-তালাকের মতো স্পর্শকাতর বিষয় ডিজিটাল না হলে এখনকার যুগে বিপদেরই সম্ভাবনা বেশি। ফেসবুকে ‘ওইটা আমার স্বামী না’!, ইনবক্সে ‘সত্যি বললে বিয়েটা গোপন ছিল’, আবার কখনো কোথা থেকে হঠাৎ হাজির হয় ‘আমি তার প্রথম স্ত্রী’ -এসব জটিলতা সমাধানে ডিজিটাল ডাটাবেইজই পারে আমাদের সমাজকে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে।

ডিজিটাল বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হলে যে সুবিধা মিলবে- গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে টিকবে না : বর্তমানে কেউ কেউ বিয়ে করে এমনভাবে লুকিয়ে রাখেন, যেন জাতীয় নিরাপত্তার তথ্যও এত গোপন থাকে না। ডিজিটাল রেকর্ড হলে নিকাহ্ খাতার পাতায় পাতা উল্টে খুঁজতে হবে না-মাত্র এক ক্লিকেই জানা যাবে, তিনি অবিবাহিত, বিবাহিত, নাকি ‘জটিল’ অবস্থায় আছেন।

বিয়ের তারিখ ভুলে যাওয়া, মেহেদির ডিজাইনের ছবি হারিয়ে ফেলা, কিংবা কবে তালাক হলো এসব নিয়ে পারিবারিক ঝগড়া কমবে। সব কিছুই থাকবে ‘সরকারি অ্যাপ’-এ, চাইলে বউ-শাশুড়ি দুজনেই লগইন করে মিলিয়ে নিতে পারবেন।

প্রতারণায় লাগবে ‘ডিজিটাল আইডি কার্ড’

যে ছেলেটা বিয়ের দিন বলছিল- ‘আমি সরকারি চাকরি করি’, পরে দেখা গেল সে ফ্রিল্যান্সার-এমন ঘটনা কমবে। কারণ ডিজিটাল সিস্টেমে জাতীয় পরিচয়পত্র লিঙ্ক করার পর আর মিথ্যে বলা কঠিন হবে।

তালাক রেজিস্ট্রেশনও ডিজিটাল হলে দম্পতিদের ‘কে আগে আবেদন করল’-এ নিয়ে ঝগড়া কমবে। আর তালাকের কাগজ হারিয়ে গেল বলে আবার নতুন করে তালাক দিতে হবে- এমন গল্পও আর থাকবে না।

বরং অ্যাপে নোটিফিকেশন চলে আসবে- আপনার তালাক আবেদন গৃহীত হয়েছে। দয়া করে ৯০ দিন শান্ত থাকুন। দেশ যখন ড্রোন দিয়ে ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও করে, রোবট দিয়ে দোকানে চা বানায়, তখন বিয়ে-তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের রেকর্ড রেখে যদি এখনো খাতার পাতায় কলম দিয়ে লিখতে হয় তাহলে তো সেটা প্রযুক্তির প্রতি অবিচার।

হাইকোর্ট ইতোমধ্যে এই বিষয়ে রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। আমরা আশা করি শিগগিরই বিয়ে ও তালাকের ডিজিটালাইজেশন বাস্তবায়িত হবে-যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর বলতে না পারে, ‘আমি তো ভাবছিলাম সে অবিবাহিত অথচ ডাটাবেজে দেখি, সে তো তিনবার বিবাহিত!’

বিয়ে ও তালাক, পারিবারিক জীবনের দুই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর প্রতিটি ধাপ শুধু ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার নয়; এগুলো সামাজিক, আইনগত ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে। তাই এই দুই প্রক্রিয়ার সঠিক, নির্ভুল ও স্বচ্ছ রেকর্ড রাখা রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে-তালাক নিবন্ধন ব্যবস্থা কাগজ-কলমনির্ভর একটি প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যার ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ রেজিস্ট্রেশনে অনিয়ম, ভুল তথ্য, প্রতারণা কিংবা জালিয়াতির ঘটনা প্রায়শই দেখা গেছে।

হাইকোর্টে উত্থাপিত সাম্প্রতিক রিট এবং চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণার অপেক্ষা- এই বিষয়টিকেই সামনে নিয়ে এসেছে। মূল প্রশ্ন হলো : ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে কেন এখনো বিয়ে ও তালাকের মতো মৌলিক তথ্যগুলো কেন্দ্রীয় ডাটাবেইজে সংরক্ষিত নয়?

বিয়ের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে প্রতারণার ঘটনা নতুন নয়। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি আগের বিয়ে গোপন রেখে নতুন বিয়ে করেছেন-অথচ রেজিস্ট্রেশন হাতে-কলমে হওয়ায় অতীতের তথ্য যাচাই প্রায় অসম্ভব। একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ডাটাবেস থাকলে নিকাহ্‌ রেজিস্ট্রার, আদালত বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহজেই তথ্য যাচাই করতে পারবেন। এটি শুধু প্রতারণা রোধই করবে না, বরং দুই পক্ষের পরিবার ও সমাজও সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাইকোর্টের  আইনজীবী মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বিয়ের নথি হারিয়ে যাওয়া, রেজিস্টারের পৃষ্ঠা নষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা ভুল তথ্য লেখা- এসব কারণে বহু মানুষ আইনি ও সামাজিক ঝামেলায় পড়েছেন। বিশেষত তালাকের ক্ষেত্রে কাগজপত্রে অসঙ্গতি থেকে দেখা দেয় উত্তরাধিকার, দেনমোহর, ভরণপোষণসহ নানা আইনি জটিলতা। ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন থাকলে এসব নথি চিরস্থায়ীভাবে সুরক্ষিত থাকবে এবং প্রয়োজন হলে দ্রুত যাচাই করা যাবে।’

ঢাকা জজ আদালতের আইনজীবী কে এম খাইরুল কবির এ প্রসঙ্গ টেনে  বলেন,  ‘একটি দেশ কীভাবে সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করবে, যদি নাগরিক জীবনের মৌলিক তথ্যই সঠিকভাবে নথিবদ্ধ না থাকে? বিয়ের হার, তালাকের হার, বয়সভিত্তিক বৈবাহিক তথ্য-এসবই রাষ্ট্রকে পারিবারিক, সামাজিক ও জনসংখ্যাগত নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে। ডিজিটাল ডাটাবেস থাকলে নীতিনির্ধারকরা আরও নির্ভুল ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।’

আইনজীবী শিরিন সুলতানা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমাদের দেশের নারীরা প্রায়ই ভোগেন তথ্যগত বিশৃঙ্খলার কারণে। স্বামী পূর্বে বিবাহিত ছিলেন কি না- তা গোপন থাকার ফলে অনেক নারী প্রতারিত হন। আবার তালাকের কাগজপত্র নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়ে তারা আইনি অধিকারের বঞ্চনার শিকার হন। ডিজিটাল সিস্টেম নিশ্চিত করবে-বিয়ের তথ্য, তালাকের নোটিশ, দেনমোহর বা অন্যান্য আইনগত সুবিধা নিয়মিতভাবে নজরদারি করা যায়।’

রাজধানী দক্ষিণাঞ্চলের কাজী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি দেশের প্রশাসনিক রেকর্ড ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন এখন অপরিহার্য। জন্মনিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র-সবকিছু যখন প্রযুক্তিনির্ভর, তখন বিয়ে-তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ নথি কেবল খাতার পাতায় থেকে গেলে ফাঁকফোকর থেকেই যাবে। এই প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করার মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো আরও দৃঢ় হবে।’

ঢাকার পারিবারিক আদালতে দুই বছর ধরে বিচারের আশায় ঘুরছেন ডেমরা এলাকার সায়রা খাতুন। জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই রিপোর্ট কইরা কি হইবো। আমার বিয়ার দিন কাজী শুনাইলো পাঁচ লাখ টাকা কাবিন। আমি পড়ালেখা জানি না বলে ওরা কাবিনে দেখাইলো মাত্র এক লাখ টাকা। এই নিয়া গ্যাঞ্জাম।  জামাই আমারে ছাইড়া দিছে। ভরণপোষণ দেয় না। কোর্টে  মামলা করছি। কাবিননামা যদি মেশিনে লিখা লইতো তাইলে আর আমার এই বিপদ হইতো না। আমিও চাই বিয়া সাদি, তালাক সবকিছু মেশিন দিয়া হউক।’

বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার আজ প্রতিটি খাতে বিস্তৃত। এমন একটি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে ও তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আইনি রেকর্ডের ডিজিটালাইজেশন বিলম্বিত হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। হাইকোর্টের নির্দেশনা ও সরকারের উদ্যোগ দেশকে আরও স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং তথ্যনির্ভর প্রশাসনিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা করেন আইনজ্ঞ ও ভুক্তভোগীরা। বিয়ে ও তালাকের ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন হবে নাগরিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা, সামাজিক ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত এবং রাষ্ট্রের আধুনিকায়নের আরেকটি শক্ত ভিত্তি।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর