Logo

আইন ও বিচার

ডিএমপি কমিশনারের ‘গুলির নির্দেশনা’ আইনি কাঠামো কী বলে?

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১২

ডিএমপি কমিশনারের ‘গুলির নির্দেশনা’  আইনি কাঠামো কী বলে?

রাজনৈতিক সহিংসতা ও আগুন-সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর বেতার বার্তার মাধ্যমে দেওয়া ‘গুলির নির্দেশনা’ নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এর পাঁচ দিন আগে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার একই ধরনের নির্দেশ দেন, যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রশ্ন উঠেছে- বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এমন নির্দেশনার বৈধতা কতটুকু?

বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় “ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা” বা Right of Private Defence–এর বিধান রয়েছে।

দণ্ডবিধি ৯৬ বলছে: ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকার প্রয়োগকালে সংঘটিত কোনো কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।

৯৭-১০৬ ধারায় বলা আছে- নিজের বা অন্যের জীবন, দেহ বা সম্পদ রক্ষার্থে ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগ করতে পারে, তবে তা হতে হবে ‘যৌক্তিক’ এবং ‘পরিস্থিতি-সাপেক্ষ’।

প্রাণঘাতী শক্তি বা lethal force কেবল তখনই বৈধ যখন আক্রমণটি জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করে এবং তা ঠেকাতে অন্য কোনো উপায় নেই।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, “আগ্নিসংযোগ, ককটেল নিক্ষেপ বা বিস্ফোরণ”- এসবই জীবন ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে গুরুতর হামলা হিসেবে গণ্য হয়। দায়িত্বরত পুলিশ যদি তাৎক্ষণিকভাবে বিপদের সম্মুখীন হয়, তখন আত্মরক্ষার নীতির আওতায় পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া আইনসম্মত হতে পারে। তবে এ শক্তি প্রয়োগ অবশ্যই হতে হবে পরিস্থিতির তুলনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ (proportionate) এবং আইনি প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে কাউকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করার নির্দেশনা আইন সমর্থন করে না।

বিবৃতির পক্ষে–বিপক্ষে মত: ডিএমপি কমিশনার নিশ্চিত করেছেন যে তিনি বেতার বার্তায় বলেছেন- “যদি কেউ বাসে আগুন দেয় বা ককটেল মেরে জীবনহানির চেষ্টা করে, তাকে থামাতে গুলি করা যেতে পারে।” ডিএমপির কয়েক কর্মকর্তা জানিয়েছেন- নির্দেশনার মূল লক্ষ্য ছিল মাঠে কাজ করা পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা ও মনোবল বজায় রাখা।

অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশকে আইনের সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সন্দেহভাজন অপরাধী বা পলাতক ব্যক্তিকেও বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা বা গুলি করার নির্দেশনা সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আইনের আশ্রয়প্রাপ্তির নিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- “গুলির নির্দেশনা” কেবল তখনই বৈধ যখন তা তাৎক্ষণিক প্রাণরক্ষা বা অপরিবর্তনীয় ক্ষতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা বাস্তবতা: শেখ হাসিনা- সম্পর্কিত মামলার রায়কে ঘিরে গত ১০ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ দেশে বেশ কয়েকটি স্থানে বাসে-ট্রেনে আগুন দেওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। অতীত অভিজ্ঞতায় রাজনৈতিক সহিংসতায় পুলিশকে ‘টার্গেট’ করার নজিরও আছে।

পুলিশের এক উপকমিশনার জানান, “মোটরসাইকেলে ককটেল ছুড়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে থামাতে গুলি করা” ছিল নির্দেশনার মূল বিষয়। তবে তিনি এটিও স্বীকার করেন যে পুলিশকে অবশ্যই দায়িত্ব পালন করতে হবে আইনের সীমার মধ্যে থেকেই।

কোন নীতিতে চলা উচিত: আইন ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে- পুলিশের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, তবে তা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোনো নির্দেশনা নির্বিচারে গুলি নয়; বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী ন্যূনতম প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগের কথা বলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রতিটি ঘটনায় জবাবদিহির আওতায় থাকতে হবে। আগুন–সন্ত্রাস ও বিস্ফোরক হামলার মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ আইনসম্মত, তবে মানবাধিকার ও সঠিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করাও সমান জরুরি।

রাজনৈতিক সহিংসতা ও আগুন-সন্ত্রাস প্রতিরোধে পুলিশের কঠোর অবস্থান নতুন নয়। তবে “গুলির নির্দেশনার” মতো বক্তব্য আইনি ব্যাখ্যা ও মানবাধিকারগত প্রশ্ন তৈরি করে। দেশের প্রচলিত আইন পুলিশকে জীবনের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার দেয়- কিন্তু সেই ক্ষমতা বিচারবহির্ভূত বা অপ্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগের ছাড়পত্র নয়।

পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও জবাবদিহি- এই তিন নীতি মানা জরুরি। 

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর