Logo

আইন ও বিচার

জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সহায়তা: আইন ও বাস্তবতা

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২০

জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সহায়তা: আইন ও বাস্তবতা

নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সাধারণভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে Election Commission of Bangladesh (ইসি) ও ক্ষমতাসীন বাহিনীর দাবি অনুযায়ী সেনাবাহিনী সহ সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর (law-enforcement agency) অংশ হিসেবে বিবেচনা ও নিয়োগ দেয়ার রীতিই বেশ কথা হয়েছে। এই প্রবণতা নিয়ে আইন, প্রক্রিয়া এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো আলোচনায় অনিবার্য।

আইন ও প্রক্রিয়া: কী বিধান রয়েছে? 

মূল আইন: Representation of the People Order, ১৯৭২ (আরপিও)। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন-সহ নির্বাচনী প্রক্রিয়া এই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নির্বাচনের সময় “law enforcement agencies” বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞা দেওয়া রয়েছে। ২০২৫ সালের রূপায়নের প্রস্তাবে ইসি জানিয়েছে, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বায়ুসেনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার চাওয়া হয়েছে।

প্রয়োগ-প্রক্রিয়া: “In aid to civil power” ও সেনা নিয়োগ ;  নির্বাচনের আগে-দিন, নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগের প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনের আগে এক প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল ৯০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ সশস্ত্র বাহিনী সদস্য দায়িত্বে থাকবে। ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক প্রতিবেদনে বলা হয়- সশস্ত্র বাহিনীকে “In aid to the civil power” ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

বাস্তবতা ও পলিসি দৃষ্টিকোণ : ইসি এক প্রস্তুতিতে বলেছে নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মধ্যে পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী নিয়োজিত করার প্রস্তাব রয়েছে।সেনাবাহিনী নিজেও জানাচ্ছে- নির্বাচনের দিকে তারা প্রস্তুত এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক হলে তারা আবার ‘শুধু নিজ এলাকায় ফিরে যাবে’ বলেছে। এছাড়া, ইসি-প্রস্তাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞার প্রসারণ ও সেনাবাহিনীকে শুধু সমর্থন বিভাগের বাহিনী নয়, নির্বাচনের সময় সরাসরি “law enforcement” হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিতে চাইছে।

সুবিধা ; বিপুল সংখ্যক ভোটার, প্রচুর কেন্দ্র ও শক্তিধর রাজনৈতিক পরিবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন এক দায়িত্ব। এই ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়োজিত থাকা ব্যবস্থাপনায় সহায়ক হতে পারে। দ্রুত মোবাইল করা যায়, বড় এলাকায় নিয়ন্ত্রণের সুবিধা থাকতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক, অস্ত্র, সহিংসতা নিরোধে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নির্ভরযোগ্যতা বাড়াতে পারে।

ঝুঁকি : যদি সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে নিয়োজিত হয়, তাহলে নাগরিক স্বাধীনতা ও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা-স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে- বিশেষ করে যদি সেনা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা মিশে যায়।সেনাবাহিনীর নিয়োগ-বহির্ভূত ক্ষেত্রে “নাগরিক প্রশাসন” ও “নির্বাচন কমিশন”-এর স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন হতে পারে। আইনগত সংজ্ঞা বা বিধান স্পষ্ট না থাকলে সেনাবাহিনী অধিক ক্ষমতায় চলে যেতে পারে, যা গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের বিপরীতে যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হলে রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›িদ্বতার ক্ষেত্রে আসন্ন দলের প্রতি নিরপেক্ষতার প্রশ্ন উঠতে পারে।

আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গেলে, নির্বাচনকালীন সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়। তবে এটা ব্যাপক স্বায়ত্তশাসিত নিয়োগ নয়, বরং “তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা” ও “নির্বাচন-উপযোগী পরিবেশ” রক্ষার উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত।

বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা-বাহিনী সংজ্ঞার প্রসারণ ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রসঙ্গে ইসি-প্রস্তাব আলোচনায় রয়েছে, যা দেখায় নিয়ম-কানুন এবং বাস্তবতার মধ্যে একটি গ্যাপ রয়েছে।

এক্ষেত্রে মূল দুটি দৃষ্টিকোণ গুরুত্বপূর্ণ: নির্বাচনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষা।আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিবেশ নিশ্চিত করা। এই দুইয়ের মধ্যে সংবেদনশীল ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে সঠিক ফল মিলবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী অংশ নিক- এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদি তাদের ভূমিকা পরিষ্কার ও স্বল্প সময়ীয় হয়, এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রধান কর্তৃপক্ষ তথা নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব না ফেলে।

সুপারিশ : ইসি ও আইনপ্রণেতাদের উচিত দ্রুত এসব প্রস্তাবিত আইন সংশোধন বা সংযোজন করা- বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়ে উদ্বোধনী নির্দেশনা ও সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ।

নির্বাচনকালীন সেনাবাহিনীর ওয়ার্ক রেঞ্জ (কাজের পরিধি) স্পষ্ট করে আইনবদ্ধ করা হোক- উদাহরণস্বরূপ, শুধু কেন্দ্র নিরাপত্তায় বা পরিবহন সাপোর্টে সীমাবদ্ধ। সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মিত তত্ত্বাবধান ও মনিটরিং থাকা জরুরি- নিযুক্ত সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্য রাজনৈতিক বিরোধী দল বা ভোটারকে ভয়ভীতি দেখাবে না। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব ও কার্যপ্রণালী নিয়ে জন সচেতনতা বাড়ানো হোক, যাতে ভোটারদের মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি তৈরি হয় এবং নির্বাচন-উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত হয়।দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নীতিতে বিবেচনা করা হোক “সেনাবাহিনী ফিরে যাক ব্যারাকে” এমন রূপায়ন, যাতে নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে যেতে পারে- অতিরিক্ত নিয়োজিত থাকা সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ দায়িত্ববহির্ভূত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছে নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠান। এটা স্বাভাবিক কারণে গ্রহণযোগ্য হতে পারে- যেখানে নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ ভোট প্রদান নিশ্চিত করা জরুরি। তবে গণতান্ত্রিক মানদণ্ড, আইনশৃঙ্খলা-স্বাধীনতা ও নির্বাচন-স্বাধীনতা বজায় রাখতে হলে আইনগত সংজ্ঞা, নিয়োগের সময়সীমা ও পরিধি, এবং নিযুক্ত সেনাবাহিনীর কার্যকারিতায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। যদি এসব ঠিক মত না হয়, তাহলে সেনাবাহিনীর সহায়তা হয়ে উঠতে পারে নিরাপত্তার ঢালে নয়- বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভয়ভীতি সৃষ্টিকারী শক্তিতে।

বিকেপি/এমবি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর