গভীর রাতে মানুষ তুলে নেওয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চর্চা নাকি আইনের অপব্যবহার?
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০৮
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পুনরাবৃত্তি হয়েছে- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গভীর রাতে বাসায় অভিযান চালিয়ে সাধারণ মানুষকে তুলে নিয়ে যান এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিবার পরের সকাল পর্যন্ত জানতেই পারে না তাদের প্রিয়জন কোথায়। ঘটনাগুলো প্রতিবারই একই প্রশ্ন তোলে: আইন কি সত্যিই এমন ক্ষমতা দিয়েছে নাকি এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অসংবদ্ধ ব্যবহার?
ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC)–র ৫৪ ধারা পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়- এটি সত্য। কিন্তু একই আইনে এবং পরবর্তী আদালতের ব্যাখ্যায় স্পষ্ট করা হয়েছে, এই ক্ষমতা “অসীম” নয়, বরং “শর্তযুক্ত”।
পুলিশ কাউকে আটক করতে পারবে শুধুমাত্র তখনই যখন তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ থাকবে, গ্রেপ্তারের প্রয়োজনীয়তা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে এবং আটক ব্যক্তিকে যুক্তিসঙ্গত সময়ে আদালতে হাজির করা হবে। এখানে প্রশ্ন হলো- গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে নেওয়া কি এই যুক্তিসঙ্গততার মধ্যে পড়ে? আইন এ বিষয়ে নীরব, নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে আইন এটুকু বলে- প্রতিটি গ্রেপ্তারই হতে হবে স্বচ্ছ, সুনির্দিষ্ট ও জবাবদিহিমূলক।
রাতের অন্ধকার : আইন প্রয়োগ, নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন? বাস্তবতা হলো, রাত নামলেই নাগরিকের নিরাপত্তাবোধ কমে যায়। সেই সময়ে আকস্মিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি এবং পরিচয় না দিয়ে কাউকে নিয়ে যাওয়া আইনের চেয়ে বেশি ভয় ও অনিশ্চয়তার রাজনীতি তৈরি করে। যখন গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা পরিচয় জানান না, পরিবারকে বলা হয় না কোথায় নেওয়া হচ্ছে এবং আটককে পরদিন পর্যন্ত স্বীকারও করা হয় না। তখন এটি আর আইন প্রয়োগ থাকে না; বরং অবৈধ আটক বা জোরপূর্বক গায়েব হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে।
হাইকোর্ট ইতিমধ্যে একাধিক রায়ে বলেছে- গ্রেপ্তারের কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে হবে, পরিবারের সদস্যদের অবহিত করতে হবে, আটক ব্যক্তিকে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দিতে হবে। এগুলোর যেকোনোটি না মানা সংবিধানবিরোধী।রাষ্ট্রের ক্ষমতার দ্বৈত চরিত্র ; রাষ্ট্রের হাতে আইন প্রয়োগের জন্য বলপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকে- এটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থারই অংশ।
কিন্তু সেই ক্ষমতা যখন নাগরিকের ঘুম ভাঙায়, পরিবারকে অনিশ্চয়তায় ফেলে এবং “স্বাভাবিক প্রক্রিয়া”র বাইরে অস্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয়, তখন সেটি আইনের শাসনের বদলে ভয়ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের উপকরণে পরিণত হতে পারে।এই জায়গায় রাষ্ট্রের ভূমিকা দুই ভাগে বিভক্ত হয়- অপরাধ দমন ও নাগরিক অধিকার রক্ষা। সতর্কতার সঙ্গে ভারসাম্য না রাখলে দ্বিতীয়টি দুর্বল হয়ে পড়ে।
আইনের ব্যাখ্যা: ক্ষমতা প্রয়োগ নয়, জবাবদিহিতা কেন্দ্রিক ; কারণ আইনের মূল লক্ষ্য স্রেফ গ্রেপ্তার নয়- ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা। গ্রেপ্তারের সময় রাত-দিনের পার্থক্য না থাকলেও, জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট: আইনের বিধান ছাড়া কাউকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
৩৩ অনুচ্ছেদ নির্দেশ করে :গ্রেপ্তারের কারণ জানানো বাধ্যতামূলক, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। এগুলো শুধুই আইনি আনুষ্ঠানিকতা নয়- এগুলোই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লাগাম।
আইন কখনোই রাতকে আলাদা করে দেখেনি। কিন্তু বাস্তবে রাতের অন্ধকারই প্রায়শই অস্বচ্ছ, অজবাবদিহিমূলক আইন প্রয়োগের ঢাল হয়ে উঠেছে। মূল প্রশ্ন তাই-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি তাদের ক্ষমতা আইনের লেখা অনুযায়ী প্রয়োগ করছে, নাকি বাস্তবতা আইনকে ছাপিয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করছে?
যে রাষ্ট্রে নাগরিক গভীর রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আতঙ্কিত হয়, সেখানে আইনের শাসন নয়- অবিশ্বাসই প্রাধান্য পায়। আর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন- বিশ্বাস।
আর সেই বিশ্বাস আসে কেবল স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ এবং কঠোর জবাবদিহিতা থেকে। গভীর রাত্রে মানুষ তুলে নেওয়া বন্ধ হোক। আইনের প্রয়োগে জবাবদিহিতা আসুক। নাগরিকের নিরাপত্তা- রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের নয়, রাষ্ট্রের সুরক্ষার প্রতীক হোক। এটাই সময়- রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে যে আইন তার কাছে ক্ষমতার হাতিয়ার নয়, ন্যায়বিচারের ভিত্তি।

