Logo

আইন ও বিচার

ডাস্টবিনে নবজাতক ফেলা

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৩

ডাস্টবিনে নবজাতক ফেলা

ডাস্টবিনে ফেলে রাখা নবজাতক জীবিত হোক বা মৃত- বাংলাদেশের আইনে একটি গুরুতর অপরাধ। সমাজে প্রচলিত দারিদ্র্য, সামাজিক লজ্জা, অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ কিংবা অবিবাহিত মাতৃত্বের ভয়- এসব কারণ অনেক সময় মানুষের মানবিক বোধকে ছাপিয়ে এমন অমানবিক ঘটনার জন্ম দেয়। তবে আইনে এমন কাজের জন্য কঠোর শাস্তির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, এবং তদন্তকারীরা ঘটনার প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করে।

নবজাতক জীবিত অবস্থায় ফেলে রাখলে আইন কী বলে? (ধারা ৩১৭) :
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি (Penal Code) ১৮৬০-এর ধারা ৩১৭ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ১২ বছরের নিচের কোনো শিশুকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন স্থানে ফেলে রাখে যেখানে তার জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে- তবে তা “Exposure and abandonment of child” অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই ধারা সাধারণত জীবিত শিশুকে ডাস্টবিন, নর্দমা, রেলস্টেশন বা নির্জন স্থানে ফেলে দেওয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।

এই অপরাধের জন্য আইন সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রেখেছে। এখানে “ইচ্ছাকৃতভাবে ত্যাগ”- মানে মায়ের মানসিক অবস্থা, প্রসব-পরবর্তী পরিস্থিতি, কোনো দুর্ঘটনা হয়েছে কি না- এসব বিচার আদালত করে থাকে। তবে শিশুটি যে জীবনহানির ঝুঁকিতে ছিল বা ছিল না- এটি অপরাধ নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

নবজাতকের মৃতদেহ গোপনে ফেলে দিলে কোন ধারা প্রযোজ্য? (ধারা ৩১৮) : যদি নবজাতক জন্মের পর মারা যায় এবং তার মৃতদেহ ডাস্টবিন, নর্দমা বা নির্জন স্থানে রেখে জন্মটি গোপন করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ধারা ৩১৮- Concealment of birth প্রযোজ্য হবে। এই ধারায় সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, গর্ভধারণকে সামাজিক লজ্জা বা অসম্মানের কারণে মায়ের পরিবার গোপন করার চেষ্টা করে। মৃত নবজাতকের মরদেহ গোপনে ফেলে রাখা এমন গোপন করার স্পষ্ট উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত দেয়, এবং তদন্তকারী সংস্থা এগুলোকে অপরাধ হিসেবে সাবধানে যাচাই করে।

নবজাতকের মৃত্যু হত্যার ফল হলে? (ধারা ৩০২/৩০৪) :
যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে- মারা যাওয়ার পর ফেলে দেওয়া হয়নি- তাহলে এটি আর শুধু ৩১৭ বা ৩১৮ ধারার বিষয় নয়। এটি হয়ে যায় হত্যা (Murder) বা culpable homicide।

এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে- ধারা ৩০২ (হত্যা)- সর্বোচ্চ দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। ধারা ৩০৪ (Culpable homicide not amounting to murder)- ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ডএটি নির্ভর করে ঘটনার প্রকৃতি, শিশুর আঘাতের ধরন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর।

অনিচ্ছাকৃত প্রসব বা চিকিৎসাজনিত অবহেলা হলে? :
কখনো মা অজ্ঞান বা অসহায় অবস্থায় শিশুটি জন্ম দিতে পারে, অথবা নির্জন স্থানে প্রসবের পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে শিশুর মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিতও হতে পারে। আবার কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অবহেলায় শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসাকর্মীর বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ, হাসপাতালের বিরুদ্ধে লাইসেন্স সংক্রান্ত তদন্ত, অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু হিসেবে মামলাদা য়ের করার সুযোগ থাকে। তবে প্রতিটি ঘটনাই আলাদা এবং আদালত-ময়নাতদন্ত-ফরেনসিক রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

দায় কার? সম্ভাব্য অভিযুক্তদের তালিকা :
মা বা পিতা- যদি প্রমাণ হয় যে শিশুকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে রাখা হয়েছে বা হত্যা করা হয়েছে তাহলে পিতা/মাতা উভয়কেই অভিযুক্ত করা হতে পারে। বিশেষ করে জন্ম গোপন করার উদ্দেশ্যে মৃতদেহ ফেলে দিলে মা–পিতা উভয়ের ওপর দায় আসতে পারে।

পরিবারের সদস্য : 

পরিবারের কারও সহযোগিতা বা পরিকল্পনা প্রমাণিত হলে তারাও অভিযুক্ত হবে।

হাসপাতালের কর্মচারী :

যদি হাসপাতালে জন্মের পর নবজাতক নিখোঁজ হয় বা মরদেহ গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়- তবে প্রশাসনিক এবং ফৌজদারি উভয় দায়ই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর আসতে পারে।

সংশ্লিষ্ট মধ্যস্থতাকারী বা তৃতীয় পক্ষ :

কখনো দেখা যায় শিশুকে ফেলে রাখার কাজে দালাল বা অচেনা কেউ জড়িত থাকে- তারাও আইনের আওতায় দণ্ডিত হবে।

তদন্ত প্রক্রিয়া:

কীভাবে সত্য উদঘাটন করা হয়?

ঘটনার স্থান সিলগালা : 

ডাস্টবিন বা আবর্জনার স্থানটি পুলিশ প্রথমে সিলগালা করে প্রমাণ সংগ্রহ করে।

ময়নাতদন্ত :

মৃত নবজাতকের ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে ময়নাতদন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবিত শিশুর ক্ষেত্রে শারীরিক আঘাত বা অবহেলার চিহ্ন পরীক্ষার জন্য মেডিকেল রিপোর্ট নেওয়া হয়।

ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মা-বাবা শনাক্ত :

ফরেনসিক ডিএনএ পরীক্ষা শিশুর জৈবিক মা–বাবা শনাক্ত করতে অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি।

সিসিটিভি ও প্রযুক্তি ব্যবহার :

যেসব এলাকায় সিসিটিভি রয়েছে সেগুলোর ফুটেজ বিশ্লেষণ করে শিশুকে কে ফেলে গেছে তা শনাক্ত করা হয়।

হাসপাতাল ও ক্লিনিক তদন্ত :

শিশুটির জন্ম সংক্রান্ত নথিপত্র, চিকিৎসা-প্রটোকল, রেকর্ড- সব যাচাই করা হয়।

স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দি : 

গ্রেপ্তার হলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়, এবং সেটি তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।

কেন এমন ঘটনা ঘটে? :
বাংলাদেশে নবজাতক ফেলে রাখার ঘটনায় গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত কয়েকটি কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে- অবিবাহিত মাতৃত্বের সামাজিক চাপ, গোপন সম্পর্ক বা ধর্ষণজনিত গর্ভধারণ, আর্থিক অসহায়তা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবার বা সমাজের প্রতিক্রিয়ার ভয়, অল্পবয়সে গর্ভধারণ, প্রসব-পরবর্তী জটিল মানসিক অবস্থা (Postpartum distress)। তবে এসব সামাজিক ব্যাখ্যা অপরাধকে ক্ষমা করে না, আইন নিজের গতিতে কাজ করে।

এমন ঘটনা প্রতিরোধে কী করা যেতে পারে? :
নিরাপদ মাতৃত্বসেবা নিশ্চিত করা। গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। 

সচেতনতা বৃদ্ধি :
শিশু জন্ম নিয়ে সামাজিক ভুল ধারণা দূর করতে জনসচেতনতা জরুরি।

সংকটাপন্ন মায়েদের সহায়তা কেন্দ্র :
গোপনভাবে চিকিৎসা ও পরামর্শ পাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে অনেক অনাকাক্সিক্ষত জন্ম ও পরিত্যাগ কমবে।

নবজাতক হটলাইন ও দ্রুত রেসকিউ ব্যবস্থা :
 হাসপাতাল, পুলিশ ও সামাজিক সেবা দফতরের মধ্যে সমন্বিত জরুরি সেবা চালু করা প্রয়োজন।

সামাজিক নিরাপত্তা ও পরিবার পরিকল্পনা প্রচার : 
অনিয়ন্ত্রিত গর্ভধারণ কমলে এমন ঘটনার সংখ্যাও কমবে। ডাস্টবিনে নবজাতক ফেলে রাখা শুধু আইনে অপরাধ নয়, এটি মানবিকতার বিরুদ্ধে এক চরম নিষ্ঠুর কাজ। বাংলাদেশের আইনে এই অপরাধের শাস্তি স্পষ্ট, এবং পুলিশ–ফরেনসিক–আদালত যৌথভাবে এর তদন্ত করে থাকে। প্রতিটি ঘটনার পেছনে একেকটি জটিল সামাজিক বাস্তবতা থাকে। তবে আইন, সমাজ এবং রাষ্ট্র সকল পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা কমিয়ে আনতে। 

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর