স্ত্রীর একতরফা তালাক স্বামীর কাছে না পৌঁছালে কি কার্যকর?
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৫০
বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক প্রক্রিয়া কীভাবে কার্যকর হয়— এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা। বিশেষ করে স্ত্রী একতরফা তালাক দিলে নোটিশ স্বামীর কাছে না পৌঁছালে তালাক আদৌ বৈধ হয় কি না, তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। পারিবারিক আদালত, কাজি অফিস ও আইন বিশেষজ্ঞরা এক মতেই বলছেন- নোটিশ ছাড়া তালাক কার্যকর হতে পারে না, তা তালাক যেই দিক- স্ত্রী বা স্বামী।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কিছু স্ত্রী কাজির মাধ্যমে বা হাতে লিখিত নোটিশ পাঠানোর দাবি করলেও স্বামী নোটিশ পাননি বলে অভিযোগ করছেন। স্বামীদের অনেকেই জানান, স্ত্রী বিচ্ছেদ হয়েছে দাবি করলেও ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর অফিস থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক নোটিশ তারা পাননি। ফলে তালাক কার্যকর হয়েছে কি না তা নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক ও আইনি জটিলতা।
আইন কী বলে? :
বাংলাদেশে মুসলমানদের পারিবারিক সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ নিয়ন্ত্রিত হয় Muslim Family Laws Ordinance, 1961 (MFLO)- এর অধীনে। এই আইনের ধারা ৬ তালাকের পুরো প্রক্রিয়াকে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যাখ্যা করে। আইন অনুযায়ী তালাক অবশ্যই লিখিত হতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী (যার হাতে তালাকের ক্ষমতা আছে) লিখিত তালাকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরকে নোটিশ আকারে পাঠাবেন। নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান উভয় পক্ষকে অবহিত করবেন। নোটিশ পাওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিন না গেলে তালাক কার্যকর হয় না। এই ৯০ দিনের মধ্যে পুনর্মিলনের সুযোগ রাখাই আইনের উদ্দেশ্য।
আইনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো- নোটিশ কার্যকরভাবে প্রাপকের কাছে পৌঁছানো না হলে তালাক আইনি স্বীকৃতি পায় না। অর্থাৎ নোটিশ পাঠানো হয়েছে কিনা শুধু তা নয়, নোটিশ পৌঁছানোর প্রমাণ থাকা জরুরি।
স্ত্রী কি একতরফাভাবে তালাক দিতে পারেন? :
অনেকেই মনে করেন, স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছামতো তালাক দিতে পারেন। হকিকতে বিষয়টি কবিননামার ওপর নির্ভরশীল। যদি কবিননামায় তালাক-ই-তৌফিজ (Delegated power of divorce) নামে পরিচিত ক্ষমতা স্ত্রীকে প্রদান করা থাকে, তাহলে তিনি স্বামীর মতোই তালাক দিতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রেও গঋখঙ অনুযায়ী নোটিশ পাঠানো বাধ্যতামূলক।
যদি কবিননামায় এমন ক্ষমতা না থাকে, তাহলে স্ত্রী একতরফাভাবে তালাক দিতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে তাকে আদালতের মাধ্যমে খুলা (কযঁষধ) বা বিচারিক বিচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় যেতে হয়।
নোটিশ না পৌঁছালে কী হয়? : এই প্রশ্নটিই বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত। আইনজীবীদের মতে, নোটিশ তালাকের “মেরুদণ্ড”। নোটিশ না পৌঁছানো মানে তালাক শুরুই হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ বা কাউন্সিলর নোটিশ পাওয়ার রেজিস্টারে নাম, তারিখ, প্রেরণের ঠিকানা এবং কুরিয়ার বা ডাক বিভাগের প্রাপ্তি রসিদ রাখতে বাধ্য। এই রেকর্ড না থাকলে তালাক কার্যকর হয়েছে বলে ধরা যায় না।
একজন অভিজ্ঞ পারিবারিক আইনজীবী বলেন, “আইন স্পষ্টভাবে বলছে, সংশ্লিষ্ট অফিসে নোটিশ পৌঁছানো এবং পরে উভয় পক্ষকে অবহিত করা ছাড়া তালাক সম্পূর্ণ হতে পারে না। শুধু স্ত্রী বললেন- ‘আমি তালাক পাঠিয়েছি’-এটাই যথেষ্ট নয়।”
এ বিষয়ে আদালতের অবস্থানও একই। পারিবারিক আদালত একাধিক মামলায় বলেছে- নোটিশের যথাযথ প্রমাণ না থাকলে তালাক বৈধ নয়। ভুল ঠিকানায় পাঠানো বা ইচ্ছাকৃতভাবে নোটিশ গোপন করা হলেও তালাক আইনি স্বীকৃতি পায় না।
বাস্তব সমস্যার কারণ কী? :
নোটিশ সংক্রান্ত বিভ্রান্তির তিনটি প্রধান কারণ দেখা যাচ্ছে-
আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা: অনেকে মনে করেন মৌখিক তালাক বা কাজির কাগজ দিলেই তালাক হয়ে যায়।
ভুল ঠিকানা ব্যবহার :
নোটিশ ভুল বা পুরোনো ঠিকানায় পাঠানো হলে তা কার্যকর হয় না।
নথিপত্রের দুর্বলতা:
অনেক ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে প্রেরণ রেজিস্টার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না।
ফলে একটি ভুল নোটিশের কারণে আদালতে মামলা, সন্তান হেফাজত নিয়ে জটিলতা, মেহর দাবি- অস্বীকার এবং নতুন বিয়ে সংক্রান্ত সমস্যাও দেখা যায়।
নোটিশ প্রক্রিয়া আধুনিকায়নের প্রস্তাব :
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, নোটিশ বিতরণ পদ্ধতি আধুনিক করা জরুরি। রেজিস্টার্ড ডাক ও কুরিয়ারের পাশাপাশি এসএমএস নোটিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা, ইউনিয়ন পরিষদে ডিজিটাল নোটিশ রেজিস্টার তালাক-সংক্রান্ত তথ্য নাগরিকদের বুঝতে সহজ সাধারণ বাংলায় নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে। ভুল ঠিকানা রোধে জাতীয় পরিচয়পত্রভিত্তিক তল্লাশির ব্যবস্থা করলে এতে নোটিশ জটিলতা কমে তালাক প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে বলে তারা মনে করেন।
স্ত্রী একতরফাভাবে তালাক দিক বা স্বামী-নোটিশ ছাড়া তালাক কার্যকর নয়- এটি বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন ও আদালতের রায়ের একটিই অভিন্ন ব্যাখ্যা। তালাক কোনো মৌখিক ঘোষণা নয়, বরং একটি সুসংগঠিত আইনগত প্রক্রিয়া, যেখানে প্রথম ধাপই হলো নোটিশ। সেই নোটিশ যথাযথভাবে জারি ও প্রাপ্তির নিশ্চিত প্রমাণ না থাকলে তালাক আইনগত স্বীকৃতি পায় না।
আইনজীবীরা বলছেন, “নাগরিকদের উচিত তালাক প্রক্রিয়াকে হেলাফেলা না করা। একটি তালাকের নোটিশ ভুল হলে এর প্রভাব আজীবন বহন করতে হতে পারে।
বিকেপি/এমবি

