গান-কবিতায় ধর্ম ও স্রষ্টাকে কটাক্ষ : আইনগত বিধান ও প্রয়োগের বাস্তবতা
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৫
বাংলাদেশে গানে, কবিতায় বা ডিজিটাল মাধ্যমে ধর্ম বা স্রষ্টাকে কটাক্ষ করা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার ঘটনা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য। দণ্ডবিধি (Penal Code) এবং ডিজিটাল আইন (বর্তমানে Cyber Security Act, 2023) উভয়েই “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত” সংক্রান্ত ধারা রাখে। তবে আদালতে শাস্তি ও অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, বিশেষ করে বাক স্বাধীনতা ও ধর্মীয় অনুভূতির মধ্যে সুষমতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে। হাইকোর্ট এমন আদালতীয় মনোভাবও প্রকাশ করেছে যে শাস্তি আরও কঠোর হওয়া উচিত- এমনকি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড প্রণীত করার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ম গরিষ্ঠ সমাজে ধর্মীয় চর্চা ও মূল্যবোধ খুব সংবেদনশীল। সামাজিক বা ডিজিটাল মিডিয়ায় ধর্মীয় মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে লেখা বা গাওয়া হলে তা দ্রুত আলোচনায় আসে।
ডিজিটাল যোগাযোগ ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তারে এই ধরনের কটুক্তি বা “বিদ্বেষমূলক মন্তব্য” দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা সামাজিক অস্থিরতা বা সম্প্রদায় বিরোধের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। আইনপ্রণেতারা এবং বিচারব্যবস্থা এ ধরনের মন্তব্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন, কিন্তু মানবাধিকার ও বাক স্বাধীনতার সঙ্গে টানাপোড়েন রয়েছে।
আইনগত কাঠামো : দণ্ডবিধি (Penal Code, 1860) ধারা ২৯৫ অ: `উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুঃখভাবপূর্ণভাবে ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করার জন্য কথা, লেখা বা দৃশ্যায়ন” থাকলে শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা, বা উভয় হতে পারে।'
ধারা ২৯৮ : কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে চোট দেয়ার উদ্দেশ্যে শব্দ, অঙ্গভঙ্গি বা অবমাননাকর আচরণ করলে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা, বা উভয় দণ্ড প্রযোজ্য।
ডিজিটাল আইন- দ্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (DSA, 2018) DSA-Gi -এর ধারা ২৮ (Publication, Broadcast etc. that hurts religious sentiment): ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা কোন বক্তব্যকে অপরাধ হিসেবে দেখেছে।
শাস্তি : প্রথমবার অপরাধ হলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং/অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অপরাধ পুনরাবৃত্ত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা। মানবাধিকার বিশ্লেষণকারী সংস্থাগুলোর মতে, এই ধারা খুব অস্পষ্ট এবং বাক স্বাধীনতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। নবায়িত আইন- সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (Cyber Security Act, 2023) DSA-এর কিছু বিধান নতুন আইন Cyber Security Act (CSA) -এ স্থান পেয়েছে, তবে শাস্তি পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে `ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' (hurting religious sentiment)) ধারা শাস্তি কমিয়ে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাবাস বা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাধকে নন-বেইলেবল (জামিনযোগ্যতা বাতিল) করা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড রাখা উচিত। মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক গোষ্ঠী প্রশ্ন তুলেছে যে CSA আসলে DSA-এর `নতুন মোড়ক' মাত্র, কারণ ধারাগুলি অনেকাংশেই আগের মতোই রয়েছে এবং শব্দাবলী অপরিষ্কার ।
বাক স্বাধীনতা বনাম ধর্মীয় সম্মান : আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্য ধর্মীয় সংবেদনশীলতা সুরক্ষা করা হলেও, অপরাধ ধারা অত্যন্ত বিস্তৃত ও অস্পষ্ট হলে এটি বাক স্বাধীনতার উপর দমনমূলক প্রভাব ফেলতে পারে। একাধিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বলেছে যে, আন্তর্জাতিক স্বাধীনতা অভিব্যক্তি মানদণ্ড (যেমন ICC কমিটি জেনারেল কমেন্ট নং ৩৪) অনুযায়ী, ধর্মীয় কটুক্তিকে উৎসাহিত শাস্তি দেওয়া `অনুচিত' হতে পারে।
নন-বেইল ও মৃত্যুদণ্ড-বিচারব্যবস্থায় উদ্বেগ : হাইকোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী ধর্মীয় অবমাননায় নন-বেইল এবং মৃত্যুদণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে তীব্র সমালোচনায় রয়েছে।
এমন পদক্ষেপের ফলে আইনের অপব্যবহার, মতামত দমনের সুযোগ বাড়তে পারে।
আইনগত অস্পষ্টতা এবং প্রয়োগ সমস্যা : ধর্মীয় “মূল্যবোধ” বা “বেদনশীলতা” কীভাবে সংজ্ঞায়িত হবে- এই দৃষ্টিকোণ থেকে CSA-এর ধারা মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। মামলা ও দণ্ডবিধির কার্যকারিতা বিচারিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। শুধু আইন থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব : ধর্মীয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাব আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে বড় ভূমিকা রাখে। আইন কঠোর হলেও, যদি প্রয়োগ পক্ষপাতদুষ্ট হয় বা রাজনৈতিক প্রভাব থাকে, তবে এটি নিরপেক্ষভাবে কার্যকর হবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়।
পাশাপাশি এই আইনের মাধ্যমে মতভিন্নতা, বিদ্বেষ বা সম্প্রদায়গিরির সুযোগও তৈরি হতে পারে।
নিরপেক্ষ তদারকি: অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারব্যবস্থা গঠন করা দরকার, যাতে আইন রাজনৈতিক বা একপক্ষীয় ব্যবহার থেকে মুক্ত থাকে। সচেতনতা ও শিক্ষা: ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও বাক স্বাধীনতার মান সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা বাড়ানো উচিত; স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও জনগণকে সংলাপে রাখা জরুরি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মিলিয়ে আইন প্রক্রিয়া করা: মর্যাদাপূর্ণ মানবাধিকার চুক্তি ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে আইন পরিমার্জন করা যায়।
বাংলাদেশে গানে, কবিতায় বা ডিজিটাল মাধ্যমে ধর্ম বা স্রষ্টাকে কটাক্ষ করার ঘটনা শুধু সামাজিক সমস্যা নয়- এটি আইনগত এবং নীতিগত দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর অন্বেষণ দাবি করে। বর্তমান আইন যেমন দণ্ডবিধি ও Cyber Security Act রয়েছে, কিন্তু তাদের সংজ্ঞা, প্রয়োগ এবং শাস্তির মাত্রা নিয়ে বড় প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে। সুষম বিচার, মানবাধিকার এবং বাক স্বাধীনতা বজায় রেখে আইন প্রয়োগ করতে সরকার, বিচারব্যবস্থা ও সামাজিক গোষ্ঠীদের মধ্যে সমন্বয় ও সচেতনতা অত্যাবশ্যক।
এনএ

