Logo

আইন ও বিচার

ভুল রেকর্ডে জমি হারানোর ঝুঁকি সিএস পর্চা বাতিলে জটিলতা

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫২

ভুল রেকর্ডে জমি হারানোর ঝুঁকি  সিএস পর্চা বাতিলে জটিলতা

বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সিএস (Cadastral Survey) ও এসএ (State Acquisition) পর্চা-সংক্রান্ত বিরোধ। একদিকে সরকারি জরিপের ভুল, অন্যদিকে প্রতারণা ও জালিয়াতিতে রেকর্ডভুক্ত সম্পত্তি হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আদালত, আইনজীবী, ভূমি অফিস- সব জায়গা ঘুরেও অনেকেরই জমি উদ্ধার হচ্ছে না।

বাংলাদেশের খবরের আজকের এই প্রতিবেদনের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনার একাধিক সিভিল আইনজীবী, সাবেক ভূমি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ভীতিকর সত্য- “ভুল পর্চা আজ বাংলাদেশের ভূমি বিরোধের মূল শেকড়।”

সিএস-এসএ পর্চা বাতিল- কখন প্রয়োজন? : 

ভুল রেকর্ডই সবচেয়ে বড় কারণ। জরিপের সময় প্রকৃত মালিক উপস্থিত না থাকলে বা ভুলভাবে দখল দেখালে সিএস ও এসএ রেকর্ডে বড় ধরনের অসঙ্গতি দেখা যায়। বিশেষত নামজারি ভুল, উত্তরাধিকারীর নাম বাদ পড়া,

সীমা নির্ধারণে ভুল, দখলকারী ও মালিক ভিন্ন হওয়া, রেকর্ডম্যান/সার্ভেয়ারদের ত্রুটি বা দুর্নীতি,

ভূমি আইনের একজন সিনিয়র আইনজীবী (অনুরোধে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন,

“বাংলাদেশে যে জমি নিয়ে মামলা হয় তার অন্তত ৬০%-এর উৎস সিএস বা এসএ রেকর্ডের ভুল। রেকর্ড ভুল হলে মালিকানাও ভুল হয়ে যায়।”

আইনজীবীদের বক্তব্য : 

‘পর্চা বাতিলের সবচেয়ে শক্তিশালী পথ আদালত। দেশের নামকরা সিভিল আইনজীবীরা এ প্রতিবেদককে যে তথ্য জানিয়েছেন তা হলো- বর্তমানে সিএস/এসএ রেকর্ড বাতিল বা সংশোধনের তিনটি পথ থাকলেও সিভিল কোর্টই সবচেয়ে কার্যকর।’

অভিজ্ঞ আইনজীবী মুজিবুর রহমান গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রশাসনিক আপত্তিতে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না। আপনার জমি যদি ভুল নামে রেকর্ড হয়ে থাকে, আদালতের ডিক্রি ছাড়া সেটা বাতিল হয় না।’

আরেক আইনজীবী মোবারক হোসেন বলেন, ‘রেকর্ড সংশোধন বা বাতিল করতে হলে দলিল, দখল, কর রশিদ- সবকিছু শক্তভাবে প্রমাণ করতে হয়। দুর্বল প্রমাণ থাকলে বিজয় অসম্ভব।’

কোন আইনে সিএস/এসএ পর্চা বাতিল? :

রাষ্ট্র অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০, এসএ রেকর্ড ভুল হলে ধারা ১৪৩: সংশোধন, ধারা ১৪৪: আপত্তি, ধারা ১৪৫-১৪৭: আপিল ও রিভিশন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এসএ রেকর্ডের ভুল প্রশাসনিকভাবে সংশোধন করা সম্ভব, তবে বিরোধ জটিল হলে আদালতই শেষ ভরসা।’

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ আইন, ২০১৭ :

এই আইনটি আরএস/ডিএস বা ডিজিটাল রেকর্ডে ব্যবহৃত হলেও সিএস–এসএ ভুল সংশোধনে এখন এ আইনও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ধারা ৬৩–৬৬: ভুল রেকর্ড সংশোধন, আপিল, রিভিশন, সিভিল প্রসিডিউর কোড + স্পেসিফিক রিলিফ অ্যাক্ট রেকর্ড বাতিলের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ-  Section 42, Specific Relief Act- Declaratory Suit, Order 7 Rule 1 -সিভিল কোর্টে রেকর্ড বাতিল মামলা। জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবী পিকে আব্দুর রব বলেন, ‘এই ধারা দিয়েই সিএস-এসএ বাতিলের ৯০% মামলাই পরিচালিত হয়।’

প্রতারণা হলে ফৌজদারি মামলা :

যদি রেকর্ড জালিয়াতি করে তোলা হয় তাহলে দণ্ডবিধির ৪৬৫, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ধারা।

আইনজীবী কেএম খায়রুল কবির মন্তব্য করে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘দলিল বা জরিপে জালিয়াতি প্রমাণ হলে ফৌজদারি মামলাও করা যায়।  এটি প্রতারকদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অস্ত্র।’

প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বক্তব্য :

‘একই জমির তিনটি রেকর্ড- বিরোধ হবেই’। একজন সাবেক ভূমি কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাংলাদেশে তিন ধরনের জরিপ- ঈঝ, ঝঅ, জঝ- এর মধ্যে যদি সামঞ্জস্য না থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মালিকানা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। একটি রেকর্ডে মালিক অ, আরেকটায় ই- তাহলে মামলাই হবে।’

তিনি আরও যোগ করেন যে, ‘সিএস জরিপ হয়েছে ১৯১০-এর দিকে, এসএ ১৯৫০-এর দিকে, আরএস বেশি হয়েছে ১৯৮০-এর পরে। এত সময় ব্যবধানে জমির দখল ও মালিকানা বদল হওয়া স্বাভাবিক। সেজন্য তিন রেকর্ডের মিল না থাকা অবশ্যম্ভাবী।’

সিএস-এসএ পর্চা বাতিলের প্রক্রিয়া : প্রথমে 

ভুল রেকর্ড চিহ্নিত করা, খতিয়ান সংগ্রহ

ম্যাপ মিলিয়ে দেখা, দলিল, কর রশিদ, দখল প্রমাণ সংগ্রহ করা। 

প্রশাসনিক আপত্তি  : 

উপজেলাভিত্তিক ভূমি অফিসে আবেদন, শুনানি, প্রাথমিক সংশোধন (সীমিত কার্যকারিতা) সিভিল আদালতে মামলা (ডিক্লারেশন স্যুট) করতে হয়। 

একজন সিনিয়র আইনজীবীর মতে, ‘ল্যান্ড সার্ভেগুলো কখনোই মানুষের বাস্তব দখলের সঙ্গে পুরোপুরি মিলেনি। ফলে বিরোধ স্বাভাবিক।’

বাংলাদেশে সিএস ও এসএ পর্চা বাতিল একটি দীর্ঘ, জটিল এবং প্রমাণনির্ভর প্রক্রিয়া। আইন আছে, কাঠামো আছে- কিন্তু সমস্যার মূল কারণ হলো পুরোনো ও ভুল রেকর্ড, দুর্নীতি, তদন্তের দুর্বলতা এবং জনগণের অজ্ঞতা।

আইনজীবীদের মতে, ‘রেকর্ড আপনার নামে থাকলেই জমি আপনার- এ ধারণা ভুল। দলিল +দখল+রেকর্ড- এই তিনটি মিলে মালিকানা প্রমাণ হয়।’ ভূমি বিশেষজ্ঞদের দাবি,  ডিজিটাল জরিপ, স্বচ্ছ রেকর্ড ব্যবস্থাপনা এবং জবাবদিহিমূলক ভূমি অফিস ছাড়া সিএস-এসএ পর্চা-বিরোধ কোনোদিনই শেষ হবে না।

এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর