Logo

আইন ও বিচার

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ আইন, নীতি ও নৈতিকতার সংকট

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০২

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ আইন, নীতি ও নৈতিকতার সংকট

রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন ভাতা, কোটার সুবিধা, কৃষি ভর্তুকি, বাসস্থান বরাদ্দ, ট্যাক্স ছাড়, কিংবা সরকারি চাকরিতে বিশেষ সুবিধা নাগরিকের কল্যাণের জন্য গড়ে তোলা। কিন্তু দেশে দীর্ঘদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, এসব সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকেই মিথ্যা ঘোষণা, ভুয়া কাগজপত্র বা জাল পরিচয় ব্যবহার করে অনৈতিকভাবে সুবিধা আত্মসাৎ করছেন। এই প্রবণতা শুধু রাষ্ট্রের সম্পদের ক্ষতি নয়, বরং সমাজে অন্যায় সুবিধার সংস্কৃতি তৈরি করছে।

প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশের আইন এই ধরনের অপরাধের ব্যাপারে কী অবস্থান নেয়? এবং এর আইনগত পরিণতি কী হতে পারে?

আইনের দৃষ্টি: মিথ্যা ঘোষণা সরাসরি অপরাধ 

বাংলাদেশে মিথ্যা তথ্য বা কাগজপত্র দিয়ে সরকারি সুবিধা গ্রহণ করলে তা সাধারণত তিন প্রকার আইনের আওতায় পড়ে- দণ্ডবিধি (Penal Code, 1860),  দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, সরকারি চাকরিবিধি ও প্রশাসনিক বিধিমালা।

এ ছাড়া, সংশ্লিষ্ট খাতভিত্তিক আইন যেমন- সামাজিক সুরক্ষা বিধিমালা, ভূমি ব্যবস্থাপনা বিধি, কৃষি ভর্তুকি নীতিমালা এর অধীনেও আলাদা শাস্তির বিধান রয়েছে।

দণ্ডবিধির আলোকে মিথ্যা ঘোষণায় কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি মিথ্যা ঘোষণা বা ভুয়া কাগজ দিয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণকে সাধারণত প্রতারণা, জালিয়াতি, মিথ্যা প্রমাণ ও জাল নথির ব্যবহার হিসেবে বিবেচনা করে। প্রতিটি অপরাধই জেল ও জরিমানাযোগ্য।

ধারা ৪২০ : প্রতারণা করে সুবিধা আদায় অর্থাৎ যদি কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি অর্থ, ভাতা, বাড়ি, বৃত্তি বা অন্য সম্পদ গ্রহণ করে, তবে তা প্রতারণার অপরাধ।

শাস্তি: সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- উদ্দেশ্য (mens rea)। যদি তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যই হয় সুবিধা আদায়, তাহলে অপরাধটি আরও গুরুতর বিবেচিত হয়।

ধারা ৪৬৮- প্রতারণার উদ্দেশ্যে জাল দলিল প্রস্তুত করা। ভুয়া জন্মসনদ, আয়ের সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রতিবন্ধিতা সনদ, কিংবা ভুয়া পারিবারিক তথ্য তৈরি করা হলে শাস্তি : সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড + জরিমানা।

ধারা ৪৭১- জাল দলিল ব্যবহার করা। যে কোনো জাল কাগজ ব্যবহার করাও আলাদা অপরাধ- সেটি তৈরি না করলেও। শাস্তি: সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা।

ধারা ১৯৩- মিথ্যা শপথ বা মিথ্যা ঘোষণা দেয়া। হলফনামা, আবেদনপত্র বা সরকারি ঘোষণাপত্রে মিথ্যা তথ্য দিলে শাস্তি: সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড।

এই ধারাগুলো বলে দেয়- মিথ্যা ঘোষণাকে রাষ্ট্র `সাধারণ ভুল' বা `ক্ষুদ্র অনিয়ম' হিসেবে নয়, বরং ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী যদি মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধা বা সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করা হয়, তবে তা `দুর্নীতি' অপরাধের আওতায় পড়ে। ধারা ২(ঙ): মিথ্যা তথ্য দিয়ে সম্পদ অর্জনকে দুর্নীতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত। ধারা ২৬: মিথ্যা বিবৃতি বা সম্পদের তথ্য গোপন করলে শাস্তি সর্বোচ্চ ৩ বছর জেল ও জরিমানা।

যদিও শাস্তি তুলনামূলক কম, কিন্তু দুর্নীতি আইনের অধীনে মামলা হলে ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে সমাজে এবং পেশাগত জীবনে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন।

সরকারি চাকরি আইন: চাকরি বাতিলের বিধান : সরকারি চাকরিতে প্রার্থীর বয়স, কোটার যোগ্যতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ভুয়া তথ্য দিলে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ অনুযায়ী চাকরি বাতিল, আগের প্রাপ্ত সুবিধা ফেরত, ভবিষ্যতে সরকারি চাকরির অযোগ্য ঘোষণা এসব কঠোর ফলাফল রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে আদালত বলেছেন- মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নিলে প্রাথমিক নিয়োগই অবৈধ; ফলে চাকরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল।

ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, কৃষি ভর্তুকিতে ভুয়া সুুবিধা অর্থাৎ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ভুয়া উপকারভোগী অন্তর্ভুক্ত করা একটি বড় সমস্যা।

প্রশাসনিক বিধি অনুযায়ী সুবিধা বাতিল, পূর্বে নেওয়া অর্থ ফেরত, প্রয়োজন হলে ফৌজদারি মামলা, ভবিষ্যতে সুবিধা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা।

এছাড়া ভুয়া প্রতিবন্ধিতা সনদ, ভুয়া দরিদ্র সনদ বা ভুয়া তালিকাভুক্তি অনেক সময় পুরো ইউনিয়ন/উপজেলা পর্যায়ে তদন্তের কারণ হয়।

ভূমি ও বাসস্থান বরাদ্দে প্রতারণা : বাংলাদেশের ভূমি নীতিমালা অনুযায়ী মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ভূমি বা আশ্রয়ন বরাদ্দ নিলে তা বাতিলযোগ্য।

ইতোমধ্যে বরাদ্দকৃত জমি সরকার পুন:গ্রহণ করতে পারে। উপরন্তু ফৌজদারি মামলা হতে পারে। ভূমি প্রশাসন মিথ্যা ঘোষণাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে বিবেচনা করে, কারণ জমিসম্পর্কিত অপরাধ সাধারণত প্রভাবশালী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

আইন ছাড়াও রয়েছে নৈতিক ও সামাজিক দায় 

 মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ শুধুই আইনি অপরাধ নয়- এটি নৈতিক অপরাধও। এর কারণ হলো প্রকৃত সুুবিধাভোগী বঞ্চিত হয়। যে বিধবা, যে প্রতিবন্ধী, যে দরিদ্র কৃষক- তাদের প্রাপ্য অর্থ চলে যায় অযোগ্য ব্যক্তির হাতে।

রাষ্ট্রের ওপর জনগণের আস্থা কমে যার। যখন জনগণ দেখে যে ভুয়া কাগজে সুবিধা নেওয়া যায়, তখন বৈধ পথ অনুসরণ করার আগ্রহ কমে। প্রশাসনে দুর্নীতির চক্র তৈরি হয়। মিথ্যা তথ্যকে সত্যি করতে অনেক সময় কর্মকর্তাও জড়িত থাকে- যা প্রশাসন দুর্নীতির বড় উৎস।

যারা যোগ্য নয় তারা সুবিধা পেলে- যোগ্য মানুষ বঞ্চিত হয়। সমাজে বৈষম্য আরও গভীর হয়।

রাষ্ট্রীয় সুবিধা আত্মসাৎ রোধে কিছু কার্যকর ব্যবস্থা জরুরি। তথ্য যাচাইয়ের ডিজিটাল ব্যবস্থা বিস্তৃত করা। ভুয়া পরিচয়পত্র যাচাইয়ের কঠোরতা বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে মাঠপর্যায়ের মনিটরিং বাড়ানো, নাগরিকদের মাঝে নৈতিকতার শিক্ষা জোরদার করা জনসচেতনতা বৃদ্ধি: রাষ্ট্রীয় সুবিধা `অধিকার' কিন্তু মিথ্যা ঘোষণা `অপরাধ'।

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করা কোনো `ছোটখাটো ভুল' নয়, এটি আইন ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অপরাধ। দণ্ডবিধি থেকে দুর্নীতি আইন সব জায়গায় এর কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

রাষ্ট্রীয় সুবিধা জনগণের অর্থে পরিচালিত; এর অপব্যবহার মানে জাতির সম্পদ চুরি। এ অপরাধ শুধুই রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না- এটি জনগণের ন্যায়বোধ, বিশ্বাস ও সমতার আদর্শকে ধ্বংস করে। রাষ্ট্রের সুবিধা অধিকার হতে পারে কিন্তু মিথ্যা ঘোষণা কখনোই সেই অধিকারের বৈধ পথ নয়।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইনি প্রশ্ন ও উত্তর

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর