কেন বাতিল হয়ে যায় আশ্রয়ের বৈধতা
রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১১
রাজনৈতিক আশ্রয় বা ‘অ্যাসাইলাম’ এমন একটি আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, যা কোনো ব্যক্তি তার নিজ দেশে রাজনৈতিক নিপীড়ন, নির্যাতন বা জীবন- ঝুঁকির মুখে থাকলে অন্য রাষ্ট্র তাকে প্রদান করে। বহু বছর ধরে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাজনিত কারণে বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।
তবে আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তিদের একটি অংশ পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রয়োজন, সামাজিক পরিস্থিতি, পারিবারিক বাধ্যবাধকতা কিংবা ব্যক্তিগত কাজে স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন প্রায়শই তাদের আশ্রয়ের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে এবং আশ্রয়দাতা দেশের আইনি কাঠামোর আওতায় তাদের স্ট্যাটাস বাতিল বা পুনর্মূল্যায়নের মুখে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তির মূল নীতি হলো- আশ্রয়প্রার্থী তার নিজ দেশে এমন ঝুঁকির মধ্যে আছেন, যা থেকে নিজ সরকারের পক্ষে তাকে রক্ষা করা সম্ভব নয় কিংবা সরকারই তার বিরুদ্ধে অপব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শব্দ হলো ‘well-founded fear of persecution’, অর্থাৎ নির্যাতনের যৌক্তিক, বাস্তব এবং প্রমাণযোগ্য আশঙ্কা। এই নীতিই নির্ধারণ করে কোনো ব্যক্তিকে বিদেশে আশ্রয় দেওয়া হবে কি না।
কিন্তু একজন ব্যক্তি যদি দাবি করেন যে তিনি বাংলাদেশে মৃত্যু-ঝুঁকি, রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা নিপীড়নের কারণে দেশত্যাগ করেছেন, অথচ তিনি পরে বিনা বাধায় বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে দেশে প্রবেশ করেন তাহলে আশ্রয়দাতা রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই তার পূর্বের বক্তব্যের আন্তরিকতা ও প্রকৃত ঝুঁকির প্রশ্ন তোলে। আশ্রয়ের মূল ভিত্তি ছিল সেই নির্যাতনের ভয়, যা তার দেশে ফেরার মাধ্যমে কার্যত অকার্যকর হয়ে যায়। এ কারণেই বিদেশি আইন অনুযায়ী স্বেচ্ছায় নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনকে রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিলের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত আইনের মূল কাঠামো হলো জাতিসংঘের ১৯৫১ শরণার্থী কনভেনশন এবং ১৯৬৭ প্রোটোকল। যদিও বাংলাদেশ এই কনভেনশনের সদস্য নয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলো তাদের নিজস্ব আশ্রয় আইন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কনভেনশনের নীতিগুলো অনুসরণ করে থাকে।
কনভেনশনের Article 1C এ বলা আছে- যদি কোনো শরণার্থী বা আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার নিজ দেশের সুরক্ষা গ্রহণ করেন, নিজ দেশ ভ্রমণ করেন অথবা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে আগের ঝুঁকি আর বিদ্যমান না থাকে, তাহলে তার আশ্রয় মর্যাদা ‘ceased’ অর্থাৎ সমাপ্ত ঘোষণা করা যায়। অর্থাৎ দেশে ফিরে আসা নিজেই প্রমাণ করে যে ব্যক্তি আর রাজনৈতিক নিপীড়নের আশঙ্কায় নেই।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আলাদা করে আশ্রয় বা শরণার্থী অধিকার সংক্রান্ত আইন নেই। বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলে দেশে আইনগতভাবে সাধারণত কোনো বাধা বা জটিলতা সৃষ্টি হয় না। কিন্তু বিদেশি আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ফিরে আসা তৈরি করে বড় ধরনের প্রশ্ন- যে কারণে আশ্রয়দাতা রাষ্ট্র মনে করতে পারে যে ব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুবিধা অপব্যবহার করছেন। এমনকি শুধু এক দিনের জন্য দেশে প্রবেশ করলেই অনেক দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘case review’ শুরু হয়, যা শেষ পর্যন্ত asylum cancellation - এ গড়াতে পারে।
আইনজীবীরা পরামর্শ দেন- যদি আশ্রয়প্রাপ্ত কারো পরিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে দেশে ফিরে যাওয়া একান্তই জরুরি হয়, তাহলে অবশ্যই আশ্রয়দাতা দেশের আইনজীবীর সঙ্গে আগে পরামর্শ করা উচিত। প্রয়োজনে ‘humanitarian travel document’ কিংবা ‘advance parole’- এর মতো বিশেষ অনুমতিও কিছু দেশে নেওয়া যায়, যদিও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে সেটিও কঠোরভাবে সীমিত।
রাজনৈতিক আশ্রয় এমন একটি বিশেষাধিকার, যা সাধারণ ভ্রমণ স্বাধীনতার মতো নয়। আশ্রয়ের ভিত্তি যেহেতু নিজের দেশের নির্যাতনের আশঙ্কা, তাই সেই দেশেই ফিরে যাওয়া এ আশঙ্কাকে অকার্যকর করে তুলে। আর ঠিক এই কারণেই বিদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা কোনো বাংলাদেশি যদি দেশে ফিরে আসেন, তাহলে আশ্রয়দাতা রাষ্ট্র তার স্ট্যাটাস বাতিল বা পুনর্মূল্যায়নের কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও আইনি অবস্থান অক্ষুন্ন রাখতে হলে আশ্রয়প্রাপ্তদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে সুপরিকল্পিত ও আইনি পরামর্শনির্ভর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

