প্রবাসে বসে নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রচার আইনের নতুন চ্যালেঞ্জ
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২০
বাংলাদেশের রাজনীতি ও আইনগত বাস্তবতা বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে দেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে থেকেও অপরাধ সংঘটিত হতে পারে- বিশেষ করে ডিজিটাল মাধ্যমে। সামাজিক গণমাধ্যমের বিস্তৃততা ও প্রভাবের কারণে প্রবাসে বসে অনলাইনে কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে আলোচনা, প্রচারণা বা কনটেন্ট তৈরি করা এখন আর ‘দূরবর্তী মতামত’ বা ‘ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি’ হিসেবে দেখা হয় না। বরং বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এটি স্পষ্টভাবে দণ্ডনীয় কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বর্তমান রাজনৈতিক ও আইনগত পরিস্থিতি আরও কঠোর হয়ে ওঠায়, বিষয়টি নতুন মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বতীকালিন সরকার কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল দেশের ভেতর নয়, ডিজিটাল ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠনের পক্ষে অনলাইনে প্রচার, সভা-সমাবেশ, লাইভ আলোচনা, ভিডিও তৈরি বা শেয়ার করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
Anti-Terrorism Act -এর সাম্প্রতিক সংশোধনে এমনকি ‘অনলাইনে প্রচারণা’, ‘ডিজিটাল সমাবেশ’, ‘ভার্চুয়াল সংগঠিত কার্যক্রম’- এসবকেও অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে, একজন ব্যক্তি প্রবাসে থাকলেও যদি বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো সংগঠনের পক্ষে প্রচারণা চালান, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
Cyber Security Act (CSA), Digital Security Act (DSA)–এ ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী’, ‘গোষ্ঠীগত শত্রুতা উসকে দেওয়া’, ‘সন্ত্রাসকে সমর্থন’, ‘ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা’- এসব অপরাধের উল্লেখ রয়েছে। এ আইন অনুযায়ী সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, টেলিগ্রাম, টিকটক কিংবা যেকোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এমন তথ্য, বিশ্লেষণ বা ভিডিও প্রচার করা যা নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠনকে সমর্থন করে বা তাদের বক্তব্য ছড়িয়ে দেয়, তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। আইনের ভাষা আরো কঠোর হয়েছে- এ ধরনের অপরাধ ‘সীমানাতীত’, অর্থাৎ বিদেশে বসেও করলে বাংলাদেশি নাগরিক দায়ী হবেন।
পেনাল কোডের ১২৪(ক) ধারা অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহের বিধানও বিবেচনায় আসে। যদি অনলাইনে তৈরি বা প্রচারিত কোনো কনটেন্ট রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, স্থিতিশীলতা বা বৈধ সরকারের প্রতি বিদ্বেষ বা বিদ্রোহ উস্কে দেয় বা ষড়যন্ত্র নির্দেশ করে- তাহলে কোনো ব্যক্তি প্রবাসে থাকলেও এই ধারায় অভিযুক্ত হতে পারেন। প্রযুক্তি বিশ্বকে যেমন ছোট করেছে, তেমনি আইনি দায়বদ্ধতাকেও সীমানা ছাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে প্রশ্ন উঠে- এত কঠোরতা কতটা যুক্তিসঙ্গত? এখানে দু’টি দৃষ্টিকোণ বিবেচ্য। প্রথমত, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা সর্বাগ্রে। সন্ত্রাসী বা সহিংস রাজনৈতিক সংগঠনগুলো প্রায়ই অনলাইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। প্রবাসভিত্তিক প্রোপাগান্ডা বা সমন্বয় অনেক সময় দেশের ভেতরে সহিংসতা, সংঘাত বা অস্থিতিশীলতা তৈরিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
তাই সরকার কঠোর আইন প্রয়োগকে নিরাপত্তার স্বার্থে বৈধভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দ্বিতীয়ত, বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকার ও মানবাধিকার- এসব প্রশ্নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ‘নিষিদ্ধ সংগঠন’ শব্দটির সংজ্ঞা, এর রাজনৈতিক প্রভাব, এবং মতামত ও অপরাধের পার্থক্য অস্পষ্ট থাকলে আইন অপব্যবহারের শঙ্কা সৃষ্টি হয়। কোনো সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ বা রাজনৈতিক মতামতও ভুলভাবে ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা’ হিসেবে ব্যাখ্যা হতে পারে- যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য শুভ নয়। তাই আইনি কাঠামো ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জরুরি।
বাস্তবতা হলো- আজকাল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ। প্রবাসীদের মধ্যেও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে শক্ত অবস্থান, উত্তেজনা এবং মতানৈক্য থাকে। কিন্তু সেই মতপ্রকাশ যদি নিষিদ্ধ সংগঠনকে সমর্থন, প্রচার বা সংগঠিত করার পথে যায়, তাহলে তা যে কোনো সময় আইনি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। অনেকে অবচেতনেই লাইভ আলোচনায় অংশ নেন, পোস্ট শেয়ার করেন বা কোনো ভিডিওতে মন্তব্য করেন এবং পরে বুঝতে পারেন না যে সেগুলোতে আইনগত জটিলতা তৈরি হয়েছে।
সুতরাং, প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য এখন সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। যে কোনো অনলাইন কর্মকাণ্ড বা আলোচনা করার সময় জানতে হবে। কোন সংগঠন বর্তমানে নিষিদ্ধ, কোন বক্তব্য আইনগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, এবং কোন কনটেন্টের মাধ্যমে আইন ভঙ্গের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। ব্যক্তিগত বিরোধ, রাজনৈতিক আবেগ কিংবা মতাদর্শের সংঘাত- এসবকে ডিজিটাল আইনের ভুল ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া যাবে না।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নাগরিক অধিকারও অগ্রাহ্য করা চলে না। তাই প্রয়োজন সুষম দৃষ্টিভঙ্গি। আইন প্রয়োগ হতে হবে স্বচ্ছ, ন্যায্য ও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নীতির ভিত্তিতে যাতে প্রকৃত অপরাধী জবাবদিহির আওতায় আসে এবং সাধারণ মতপ্রকাশকারীরা হয়রানির শিকার না হয়।
ডিজিটাল যুগে প্রবাসীর কণ্ঠস্বর শক্তিশালী—কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর যেন আইন, দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতার পথেই পরিচালিত হয়। নইলে অনলাইন স্বাধীনতা এক সময় আইনি বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ এখন এমনই এক সন্ধিক্ষণে- যেখানে রাজনৈতিক বাস্তবতা, আইন এবং ডিজিটাল আচরণ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। তাই সতর্কতা, জ্ঞান এবং দায়িত্ববোধ- এগুলোই হবে সময়ের দাবি।
এনএ

