রাজধানীতে গ্যাস সংকট : সরবরাহ নেই, মাসিক বিল দিচ্ছেন গ্রাহক- দায় কার?
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৫
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে গ্যাসের ধারাবাহিক ঘাটতি সত্ত্বেও গ্রাহকদের মাসিক গ্যাস বিল দিতে হচ্ছে, যা সামাজিক ও আইনগতভাবে উদ্বেগের বিষয়। নিচের প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, বর্তমান আইন ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দায় কার- গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নাকি গ্রাহক?
গত কয়েক বছরে রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে Titas Gas Transmission and Distribution Company Limited- সহ বিভিন্ন গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানির সঙ্গে গ্রাহকের নিয়মিত অভিযোগ রয়েছে যে, যদিও গ্যাস সরবরাহ নেই বা চাপ খুব কম, তবু বিল ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, মুগদা, বাসাবো এলাকায় এমন ১০,০০০-এরও বেশি গ্রাহক রয়েছেন, যারা বছর হয়ে গেছে, তবু গ্যাস পাচ্ছেন না। তবু মাসিক বিল দিচ্ছেন।
রাজধানীর বেশ কিছু এলাকার বাসিন্দা বাংলাদেশের খবরের কাছে অভিযোগ করেছেন, গ্যাস নেই, রান্না করতে গ্যাস না পেয়ে এলপি গ্যাস বা বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করতে হচ্ছে, তবু টাকার মাসিক বিল দিতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হচ্ছে- কার দায় বাড়ে, গ্রাহকের নাকি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির? আইন অনুযায়ী কি গ্রাহককে মাসিক বিল দিতে হবে?
Bangladesh Gas Act, ২০১০ এই আইনটির উদ্দেশ্য হলো গ্যাসের সঞ্চালন, বিতরণ, বিপণন ও সরবরাহ সুষ্ঠু এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে করা। গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে গ্রাহকের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাতে সাধারণত বলা হয়, কোম্পানি “পূর্ণ এবং অনবরত সরবরাহের” গ্যারান্টি দিচ্ছে না। অর্থাৎ, গ্যাস কোম্পানি চুক্তিতে এমন ধারা রাখে, যে “কারণ যাই হোক- গ্যাসের উৎপাদন, পাইপলাইন, রক্ষণাবেক্ষণ, লাইন মেরামত, যান্ত্রিক ব্যর্থতা, বা অন্যান্য কারণে” গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।
এই ধরনের ব্যাহত সরবরাহকে চুক্তিতে “নিয়মিত সরবরাহের ব্যাতিক্রম” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
চুক্তি স্পষ্ট করে বলে যে, গ্যাস কোম্পানি “অব্যাহত বা পূর্ণ গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিচ্ছে না”। অর্থাৎ, গ্যাস না থাকলে সরবরাহকারী আইনগতভাবে দায়মুক্ত, যদি ব্যাহত সরবরাহ “নিয়মিত কারণ” (যেমন পাইপলাইন রক্ষণাবেক্ষণ, সাপ্লাই সমস্যা) হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বিলিং সিস্টেমও চুক্তির অংশ। বিল সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে পাঠানো হয়। গ্রাহক যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ না করেন, বিলের সঙ্গে জরিমানা প্রযোজ্য। অর্থাৎ, আইন ও গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, “গ্যাস না থাকলেও মাসিক বিল নেওয়া” আইনগতভাবে সম্ভব। কারণ- চুক্তিতে “পূর্ণ ও অনবরত সরবরাহের” গ্যারান্টি না থাকলে, কোম্পানি সরবরাহ বন্ধ হলেও বিল দিতে গ্রাহক বাধ্য।
রাজধানীর গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গ্রাহক এক দশক ধরে গ্যাস পাচ্ছেন না, তবুও মাসে কোটি টাকার বিল পরিশোধ করছেন। রাজধানীর গ্যাস সঙ্কটের কারণে, গ্রাহকরা বিকল্প জ্বালানি (সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক) ব্যবহার করছেন। তবুও গ্যাস বিল দিতে হচ্ছে। এই বাস্তবতা সামাজিকভাবে খুবই অস্বস্তিকর; গ্যাস নেই, কিন্তু বিল ও জরিমানা- পরিবারগুলোকে আর্থিকভাবে ঘেঁষে দিচ্ছে।
গ্রাহকরা বলছেন- তারা সেবা পাচ্ছেন না, অথচ বিল দিতে বাধ্য, যা অন্যায়। অন্যদিকে, গ্যাস কোম্পানি বা আইন এই ব্যতিক্রমকে গ্যারান্টি দিচ্ছে।
দায় কার : আইন ও চুক্তির ধারা অনুযায়ী, গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইনগতভাবে দায়ী নয়, যদি তারা ‘গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করব’- এমন গ্যারান্টি না দিয়ে থাকে। চুক্তি স্পষ্টভাবে বলে যে, সরবরাহ কতটা সম্ভব হবে, এ গ্যারান্টি দেওয়া যায় না; এবং সরবরাহ ব্যাহত হলেও বিল দেওয়া যাবে। অতএব, গ্রাহক- চুক্তি অনুযায়ী মাসিক বিল পরিশোধ করার দায় গ্রাহকেরই। তবে, আইন ও ন্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে- সামাজিক ন্যায়, ভোক্তা অধিকার ও মৌলিক সেবা প্রদানের দৃষ্টিকোণ থেকে - এটি একটি গুরুতর অবিচার। কেন আইন ও বাস্তবতার মধ্যে ফাঁক? এবং সমাধানের পথে
করণীয় : গ্যাস আইন ও চুক্তিতে ‘পূর্ণ গ্যারান্টি’ না থাকায়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান একটি আনজরুরি আইনগত সুরক্ষা পেয়ে যায়। কিন্তু সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে- গ্যাস একটি মৌলিক অপরিহার্য সেবা। মাসিক বিল নেয়া হলেও গ্যাস সরবরাহ দেওয়া না হলে, গ্রাহকদের অধিকার অনুভূতি এবং বাস্তব আর্থিক ও জীবনযাত্রার ব্যাঘাত অপরিহার্য।
রাজধানীর মতো নগর অঞ্চলে, পরিবেশ, জনসংখ্যা ও গ্যাস চাহিদার চাপ বিবেচনায়, সরকার, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (Bangladesh Energy Regulatory Commission- BERC), এবং গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকে নতুন চুক্তি বা আইনগত সংশোধনের মাধ্যমে “সেবা নিশ্চিতে বাধ্য থাকলে” গ্রাহকদের দায় কমানো সম্ভব।
প্রস্তাবিত সমাধান : গ্যাস চুক্তিতে “সর্বনিম্ন সরবরাহ গ্যারান্টি” যুক্ত করা- যাতে কমপক্ষে নির্ধারিত সময় বা চাপ না থাকলে বিল দেওয়া যাবে না। দ্রুত মিটার ও প্রি-পেইড মিটার সিস্টেম চালু করা।
মিটার থাকবে, তাহলে বাস্তব গ্যাস ব্যবহারের ওপর ভিত্তিক বিল হবে; গ্যাস না থাকলে বিলও হবে না। ২০২৪ সালের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে- অবৈধ বা অমিটার লাইনের পরিবর্তে প্রি-পেইড মিটার লাগাতে হবে।
গ্রাহক অভিযোগ ও প্রতিকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা; কম গ্যাস সরবরাহ বা অনুপস্থিতির জন্য ক্ষতিপূরণ, বিল স্থগিত বা মওকুফির বিধান রাখা। নিয়মিত পরিবেশ ও গ্যাস অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা, যাতে “সরবরাহ ব্যাহত” হয় এমন কারণ কম হয়।
বাংলাদেশে গ্যাস সঙ্কট এবং অনবরত বা পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না হলেও মাসিক বিল দেওয়াকে আইনগতভাবে গ্রাহক দায়ভার হিসেবে দেখানো হয়।
তবে ন্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ভোক্তা অধিকার ও মৌলিক সেবা নিশ্চিত করার দায় সরকারের, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। যারা গ্যাস পাচ্ছেন না, মাসিক বিল দিতে বাধ্য- তারা ন্যায্য নন।
যদি রাষ্ট্র, বেসরকারি গ্যাস কোম্পানি এবং গ্রাহক সবাই মিলে একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং নাগরিক অধিকার সমর্থনীয় ব্যবস্থার দিকে না যায়, তাহলে “গ্যাস নেই, বিল আছে”- এই অবস্থা সামাজিক অবিচার হিসেবে থেকেই যাবে।
বিকেপি/এমবি

