শত্রুতা করে গাছ কাটা, মৎস্য খামারে বিষ দেওয়া ও পশুপাখি হত্যা, আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩২
ব্যক্তিগত শত্রুতা বা বিরোধের জেরে অন্যের সম্পদ, প্রাণী বা পরিবেশের ওপর আঘাত হানা- যেমন ফলজ বা অন্যান্য গাছ কেটে ফেলা, পুকুরে মাছ মারার জন্য বিষ প্রয়োগ, কিংবা পশু-পাখি হত্যা শুধু নৈতিকভাবে ভুল নয়, আইনগতভাবেও তা গুরুতর অপরাধ। দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে। নিচে সংশ্লিষ্ট আইনি ধারা, শাস্তি এবং অপরাধের প্রকৃতি বিশদভাবে আলোচনা করা হলো। শত্রুতা করে অন্যের গাছ বা ফলজ বৃক্ষ কাটা : অন্যের মালিকানাধীন গাছ, ফলজ বা বাগানের ক্ষতি করা বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর “mischief” বা অপকর্ম-সংক্রান্ত ধারার আওতায় অপরাধ। গাছ কাটা, শেকড় উপড়ে ফেলা, ফল নষ্ট করা বা অন্য যেকোনো উপায়ে গাছ/জমির ক্ষতি করলে তা সম্পত্তিনাশের অন্তর্ভুক্ত।
দণ্ডবিধি অনুযায়ী- যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কারও সম্পত্তিতে আর্থিক ক্ষতি করা হয়, এবং তা প্রমাণ করা যায় তবে দোষী ব্যক্তি সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড পেতে পারেন। ক্ষতির পরিমাণ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী শাস্তি আরও কঠোর হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ফলজ বৃক্ষ কৃষি-সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়। তাই গাছ নিধনের ঘটনা কৃষি বা পরিবেশ আইনের আওতায়ও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষত, গাছ যদি পরিবেশগত বা বনায়ন সংরক্ষণের আওতায় পড়ে, তবে পরিবেশ আইনেও আলাদা মামলা হতে পারে।
পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধন : মাছ একটি জীবন্ত প্রাণী এবং অর্থনৈতিক সম্পদ। পুকুর, ঘের বা জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধ্বংস করা দণ্ডবিধির “mischief by poisoning animals” ধারার আওতায় অপরাধ। মাছের আর্থিক মূল্য থাকায় আইনে এটিকে ‘animal property’ হিসেবেই গণনা করা হয়।
দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৪২৮ ও ৪২৯ : ধারা ৪২৮: দশ টাকা বা তার বেশি মূল্যের প্রাণীকে হত্যা বা বিষ প্রয়োগ করলে ২ বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা।
ধারা ৪২৯: গরু-জাতীয় বা উচ্চমূল্যের প্রাণী/প্রাণিসম্পদ বা মূল্য ৫০ টাকা বা তার বেশি হলে-৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা, বা উভয় শাস্তি। পুকুরের মাছ সাধারণত বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়, ফলে মাছ বিষ দিয়ে হত্যা করা সাধারণত ধারা ৪২৯-এর আওতায় গণ্য হয়, যা তুলনামূলক কঠোরতম শাস্তিযোগ্য। এছাড়াও, মাছ নিধনের ফলে পানি দূষণ হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধিবিধান অনুযায়ী এটি পরিবেশ দূষণ অপরাধ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
শত্রুতা করে পশুপাখি হত্যা বা নির্যাতন : প্রাণী হত্যা বা নির্যাতন দীর্ঘদিন দণ্ডবিধির অধীনে অপরাধ ছিল। ২০১৯ সালে পুরোনো আইন বাতিল করে Animal Welfare Act, ২০১৯ চালু হওয়ায় এখন পশুপাখির প্রতি নিষ্ঠুরতা আরও কঠোরভাবে দণ্ডনীয়।
Animal Welfare Act, ২০১৯-এর মূল পয়েন্ট হলো অকারণে হত্যা, বিষ প্রয়োগ, মারধর বা আঘাত করা, খাদ্য/পানি না দেওয়া, যাতায়াত বা ব্যবহারে নিষ্ঠুরতা, চিকিৎসা না দেওয়া- এসব কর্মকাণ্ড প্রাণিকল্যাণ আইনে সরাসরি অপরাধ।
শাস্তি : আইন অনুযায়ী যেকোনো ধরনের নিষ্ঠুরতার জন্য ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যেতে পারে। পোষা ও মালিকানাধীণ প্রাণী তো বটেই, মালিকবিহীন (stra) প্রাণীর ক্ষেত্রেও অকারণে আঘাত, হত্যা বা নির্যাতন শাস্তিযোগ্য। এই আইন অনুযায়ী সশরীরে হত্যা ছাড়াও, বিষ প্রয়োগ বা কষ্ট দানে প্ররোচনা দিলেও অপরাধ গঠিত হয়।
শত্রুতাজনিত অপরাধ সর্বদাই ‘ইচ্ছাকৃত’ অপরাধ : এ ধরনের কাজকে আইন ‘ইচ্ছাকৃত ক্ষতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। ফলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের দণ্ড লাঘবের সুযোগ কম, আর্থিক ক্ষতি, মানসিক ক্ষতি, পশু-পাখি নিধন বা পরিবেশগত ক্ষতি- সবকিছু বিবেচনায় আদালত শাস্তি নির্ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ দাবি করতেও পারেন। শত্রুতাজনিত ক্ষতি সাধারণত ফৌজদারি অপরাধ হওয়ায় পুলিশে সরাসরি অভিযোগ (জিডি বা এফআইআর) করা যায়। গাছ, মাছ, পশুপাখি সবই একেকটি সম্পদ এবং পরিবেশের অংশ। এসব ক্ষতিসাধন শুধু ব্যক্তিগত মালিকের ক্ষতি নয়; তা স্থানীয় পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং অর্থনৈতিক বৃত্তে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র- উভয়ের দৃষ্টিতেই এমন কর্মকাণ্ড গুরুতর অপরাধ। শত্রুতাবশত গাছ কাটা, মাছ বিষ দেওয়া বা পশুপাখি হত্যা- বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সবই দণ্ডনীয়। দণ্ডবিধি ১৮৬০ এবং প্রাণিকল্যাণ আইন ২০১৯-এর সমন্বয়ে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তাই এমন ঘটনা ঘটলে প্রমাণ সংগ্রহ করে দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া উচিত। আইন সচেতনতা বাড়ালে সমাজে এ ধরনের অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে।
বিকেপি/এমবি

