Logo

আইন ও বিচার

পুলিশ গৃহ তল্লাশি করতে এলে আপনার করণীয় কী?

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৮

পুলিশ গৃহ তল্লাশি করতে এলে আপনার করণীয় কী?

গৃহ তল্লাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রক্রিয়া, যা অপরাধ দমন, তদন্ত এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়। তবে, গৃহ তল্লাশি কেবল একতরফাভাবে নয়; বরং নির্দিষ্ট আইন, বিধিবিধান এবং সাংবিধানিক অধিকার বিবেচনা করেই সম্পন্ন করতে হয়।

নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে হয়রানি, ভুল বোঝাবুঝি কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই আইন অনুযায়ী পুলিশ কখন, কীভাবে এবং কোন সীমার মধ্যে গৃহ তল্লাশি করতে পারে- এ সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গৃহ তল্লাশির ভিত্তি :

তল্লাশি পরোয়ানা (Search Warrant)- এর বাধ্যতামূলকতা। সাধারণত পুলিশের গৃহ তল্লাশি আদালতের জারিকৃত তল্লাশি পরোয়ানার ভিত্তিতে করতে হয়। দণ্ডবিধির (Criminal Procedure Code—CrPC 1898) ধারা ৯৪-৯৬ অনুযায়ী বিচারক বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রাপ্ত প্রমাণ ও অভিযোগের ভিত্তিতে তল্লাশির অনুমতি দিতে পারেন। পরোয়ানায় তথ্য থাকা আবশ্যক। যে স্থানে তল্লাশি হবে তার সুনির্দিষ্ট ঠিকানা, তল্লাশির উদ্দেশ্য, সম্ভাব্য উদ্ধারযোগ্য বস্তু বা নথির বিবরণ, কার্য সম্পাদনের সময়সীমা।

পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি (Warrant-less Search) :

কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াও গৃহ তল্লাশি করতে পারে, যেমন- অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এমন যুক্তিসঙ্গত বিশ্বাস থাকলে, তদন্তাধীন মামলায় প্রমাণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকলে, অভিযুক্ত ব্যক্তি গৃহে লুকিয়ে থাকলে CrPC ধারা ১৬৫ পুলিশকে জরুরি অবস্থায় পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি করার ক্ষমতা দেয়। তবে অফিসারকে অবশ্যই লিখিতভাবে কারণ উল্লেখ করে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হয়।

নারীর ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান :  ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান বিবেচনায়, কোনো নারীকে অনুসন্ধান বা ব্যক্তিগত তল্লাশি করতে হলে নারী পুলিশ দ্বারা তা করতে হবে। গৃহ তল্লাশিতে পুলিশের বাধ্যবাধকতা ; পরিচয় প্রকাশ- পুলিশ অফিসারকে নিজ পরিচয় দিতে হবে- নাম, পদবি ও থানার নাম। পরোয়ানা প্রদর্শন- যদি তল্লাশি পরোয়ানার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তবে পরোয়ানা মালিক বা বাসিন্দার সামনে প্রদর্শন করতে হবে। গৃহের ব্যক্তি বা প্রতিনিধির 

উপস্থিতিতে তল্লাশি : তল্লাশির সময় গৃহের মালিক, আত্মীয় বা স্বাক্ষী থাকা উচিত যাতে কোনো ভুল বা অপব্যবহারের সম্ভাবনা কমে।

জব্দ তালিকা (Seizure List) :

যদি কোনো জিনিস জব্দ করা হয়, তার তালিকা তৈরি করে মালিকের হাতে কপি দিতে হবে। এতে জব্দের কারণ, সময় ও জব্দকারীর নাম উল্লেখ থাকে।

তল্লাশির সীমা : পুলিশ পরোয়ানায় উল্লিখিত সীমার বাইরে তল্লাশি করতে পারে না। সীমা অতিক্রম করলে সেটি বেআইনি বিবেচিত হবে।

গৃহ তল্লাশির সময় নাগরিকের করণীয় : শান্ত ও সহযোগিতামূলক আচরণ করুন। উত্তেজিত হওয়া বা বাধা দেওয়া পরিস্থিতি জটিল করতে পারে। আইন মানার পাশাপাশি নিজের অধিকার রক্ষার বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। যদি পুলিশ পরোয়ানা দেখাতে ব্যর্থ হয়, বিনীতভাবে জানতে চান- কোন আইনের অধীনে তারা গৃহে ঢুকছে এবং জরুরি কারণের লিখিত নোট কোথায় রয়েছে।

পরিচয় যাচাই করুন : পুলিশ সদস্যদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইতে পারেন। তারা আইন অনুযায়ী পরিচয় দেখাতে বাধ্য।

সাক্ষী রাখুন: সম্ভব হলে প্রতিবেশী বা পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক কাউকে সাক্ষী হিসেবে রাখুন। এটি তল্লাশি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখে।

ভিডিও রেকর্ড রাখা (যদি পরিস্থিতি অনুমতি দেয়) :

সরাসরি বাধা না দিয়ে সাধারণ তল্লাশি দৃশ্য ভিডিও করা যেতে পারে কিন্তু পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।

জব্দ তালিকার কপি নিন : যদি কিছু জব্দ করা হয়, সেইসব বস্তু কোনগুলো এবং কেন জব্দ হলো- এ তথ্যসহ একটি তালিকার কপি আপনার নেওয়া অবশ্যই উচিত।

আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন : যদি মনে হয় তল্লাশি বেআইনি বা হয়রানিমূলক, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব একজন আইনজীবীর সাহায্য নিন।

বেআইনি তল্লাশি হলে করণীয় : থানায় অভিযোগ (এউ) করতে পারেন। রিট আবেদন বা আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে পারেন। মানবাধিকার কমিশন বা আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারেন। বেআইনি তল্লাশি পুলিশের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাংবিধানিকভাবে বাসা-ঘর ব্যক্তির ‘গোপনীয়তার অধিকার’-এর অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশে পুলিশের গৃহ তল্লাশি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, কিন্তু এটি কখনও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যম হতে পারে না। আইন স্পষ্টভাবে বলে- তল্লাশি হবে পরোয়ানা, যথাযথ কারণ, স্বচ্ছতা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে। একইসঙ্গে নাগরিকেরও করণীয় আছে- সচেতন থাকা, অধিকার জানা এবং প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা। আইন ও সচেতনতার সমন্বয়েই একটি সুষম ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে। 

এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইনি প্রশ্ন ও উত্তর আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর